গণঅভ্যুত্থানে ভ্যানগার্ড হয়েছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা

গণঅভ্যুত্থানে কলেজের শিক্ষার্থীরা
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
1

পুরো দেশ যখন ভয় আর নিস্তব্ধতায় থমকে আছে, তখন বাঁধ ভাঙা সাহসে জনতাকে জাগিয়ে তোলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। স্বৈরশাসনের দম্ভ গুঁড়িয়ে দেশের সামনে আনে মুক্তির রাজপথ। বুক পেতে নেয়া বুলেট, সমুন্নত জাতীয় পতাকাই সাক্ষ্য দেয় দেশের জন্য শিশু কিশোরদের আত্মত্যাগের। জুলাইয়ে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মনে করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাই গণঅভ্যুত্থানের ভ্যানগার্ড।

অঙ্কুরে ঝরে গেল কত স্বপ্ন। সব মায়া পেছনে গেলে অসীমে পারি দিয়েছে সূর্য সন্তান। বিপ্লবের বছর পেরিয়েও সন্তানকে আরেকবার ফিরে পাবার আকুতিই শহিদ জননীর বাকি জীবনের সঙ্গী।

শহিদ সৈকতের মা বলেন, ‘বিকেল হলে রাস্তায় ওর বন্ধুরা খেলে। থাকলে তো সৈকতও খেলতো। এখন দেখি সবাই খেলে কিন্তু সবার মাঝে আমার ছেলেটা আর নাই।’

শহিদ সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি বলেন, ‘ওকে কখনও কোল ছাড়া করিনি। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গেলেও আমরা সময় বেধে দিতাম। আন্দোলনের সময় ও হঠাৎ করেই অনেক বড়দের মতো করে কথা বলা শুরু করে। তখন আমার কাছেই অবাক লেগেছে যে, আল্লাহ ও কীভাবে এতকিছু বোঝে।’

শহিদ সৈকতের মা বলেন, ‘আম্মু আমার বন্ধু গায়ে রাবার বুলেট লেগেছে আমি যাচ্ছি একটু। আমাকে এটা বলেই দৌড় দিছে। ওর ঘরের মধ্যে গিয়ে কী যে নিলো, শুধু ঢুকলো আর বের হইলো।’

সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি বলেন, ‘ওর আইডিতে শেষ পোস্ট যেটা আমরা দেখতে পাই সেটা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মেয়েকে মারলো নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। সেই ছবি দিয়ে ও লিখেছিল, মনে হচ্ছে এটা ওর বোন। মূলত বোনদের নিয়ে অনেক সেনসিটিভ ছিল। যখন দেখছে আন্দোলনে মেয়েদের গায়ে হাত তুলছে, এটা আর নিতে পারেনি। সৈকত একদিন নোমলো, একদিনেই শেষ।’

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে যখন সারাদেশ থমকে আছে ভয় আর নিস্তব্ধতায়, তখন প্রথম জেগেছিল স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকের চোখ পালিয়ে শিশু কিশোররাই তুলে নেন দেশ রক্ষার নেতৃত্ব। আন্দোলনে নামার পর পুলিশের হাতে অনেক সহপাঠী আটক হলে সেবছর এইচএসসি পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় নটরডেম, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা সংহতি জানালে ১৮ জুলাই থেকে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষা বোর্ড। এর পেছনে সব পথ ভুলে রণক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শপথ ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ছাত্রলীগের যে কর্মীরা ছিল, নেতারা ছিল, আমাদের কলেজেরও যারা ছিল তারা বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকি দেয় এবং হুমকি দেয়। মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত সেখানে আমাদের দিয়েছিল। তারপরও আমরা সেখানে তাদের কথায় পিছুপা হইনি।’

অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার নিজের নানাও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমি চিন্তা করছি, আমি যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় না পেয়ে, আমি আমার নিজের মেধায় পাবো। এতে করে সবাই একটা ন্যায্যমূল্য পাবে এবং তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী একটা ন্যায্য জায়গা পাবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্কুল-কলেজের ক্লাস বর্জন করে ওরা যেভাবে ওরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন ওদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলন আরও বেগবান করেছি।’

স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ সামাল দিতে ব্যর্থ হলে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র বেছে নেয় কাপুরোষোচিত পথ। রাইফেলের নলে লক্ষ্যবস্তু করা করা হয় শিশু কিশোরদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘২০ তারিখ যখন আমরা কারফিউ ভঙ্গ করি তখন আমরা যারা আছি ২৫ থেকে ৩০ বছরের, তাদের টার্গেট করা ছাড়াও সাধারণত ১৫ থেকে ২৫ বছরের ছেলেমেয়েদের টার্গেট করে গুলি করা হয়েছিল।’

কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে বাসা থেকে আমাকে এবং এক সিনিয়র ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে। তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের পৌরসভার ভেতর অনেক মারধর করেছে।’

অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের গ্রুপ ছিল, সে গ্রুপ ধরে আমাদের ফোন ট্র্যাক করে আমাদের শনাক্ত করতো। আমাদের অনেক নির্যাতন করতো। বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসতো।’

আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমাদের আহত ভাইরা যখন হাসপাতাল দিকে যাবে তখন তাদের নেয়ার সময় আমাদের আটকিয়ে দিতো। হাসপাতালের পাশে আমাদের আটকে রেখে আইডি কার্ড, ফোন সব জব্দ করে রাখে। সেখানে আমাদের হুমকি দেখিয়ে মেরে পুলিশের হাতে উঠিয়ে দিয়েছিল।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্টের পাশবিক হত্যাযজ্ঞে শহিদের সংখ্যা এক হাজার ৪০০ ছাড়ায়। যেখানে ১৩ শতাংশ অর্থাৎ অন্তত ১৮২ জন শিক্ষার্থী। আর অন্তর্বর্তী সরকারের ৮৩৪ জনের শহিদ তালিকায় ১৩২ শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করা গেছে।

যাতে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি শহিদ সরকারি কলেজে ৩০ জন এরপরই মাধ্যমিক বা হাইস্কুলের ২৫ জন ও বেসরকারি কলেজের ২১ জন।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি শহিদ কবি নজরুল সরকারি কলেজ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি তোলারাম কলেজ নারায়ণগঞ্জ, ফেনি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান সভাপতি বলছেন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাই মোড় ঘুরিয়েছিল জুলাই আন্দোলনের৷ জুলাইয়ে অর্জিত স্বাধীনতার ভ্যানগার্ড স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ বলেন, ‘ওরা যখন পরীক্ষা বয়কট করছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ওরা বলছিল আমরা ক্লাসে যাবো না, ওরা শাহবাগ থেকে প্রতিটি ব্লকেডে ওরা চলে এসেছে। এর মূল অংশে কিন্তু ছিল আসলে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। যখনই দেখবেন কোনো একটা ক্রাইসিস মোমেন্ট চলে তখনই এই ছেলেমেয়েগুলো সামনে চলে আসে। আমরা ওদের বলেছি লেখাপড়ার দিকে ফোকাস করতে। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে আসুক, তারা আমাদের সঙ্গে কানেক্টেড। এর আসলে গণঅভ্যুত্থানের ভ্যানগার্ড। গণঅভ্যুত্থান রক্ষা করে এরা।’

বুলেটের সামনে জাতিয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়েছিল ওরা, কেউ ধাওয়া খেয়ে প্রাণ দিয়েছে অচেনা গলিতে।

ছিল কলেজের প্রথম বর্ষের প্রাণ, ছিলো এইসএসচি পরীক্ষার্থী , কেউবা স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগেই বরন করেছে শাহাদাত।

এসএস