শুরু থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জন্ম ও মৃত্যুসনদ নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করতো সেন্ট্রাল সার্ভারের মাধ্যমে। তবে ২০২৩ সালের জুন-জুলাই মাসে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি নিজেদের তহবিলে জমার দাবিতে ডিএসসিসি এ নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রাখে। এরপর অক্টোবর মাসে নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শুরু করে সংস্থাটি। তবে এ সার্ভার থেকে যারা সেবা নিয়েছে তারাই পরেছে ভোগান্তিতে।
চার বছরের সেহরিস। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন হলেও তার পাসপোর্ট আটকে আছে জন্মসনদ জটিলতায়। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব সার্ভার চালুর পর ৫ নভেম্বর সেহরিসের জন্মনিবন্ধন করা হয় খিলগাঁও থেকে। এরপর সেই জন্মসনদের ভিত্তিতে চার হাজার টাকা ফি দিয়ে ২০২৫ সালের ৯ আগস্ট সেহরিসের ই পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হয়। তখনই বাধে বিপত্তি। পাসপোর্টের সার্ভারে খুঁজে পাওয়া যায়নি সেহরিসের জন্মসনদ। কারণ ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভার, সেন্ট্রাল সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত নয়।
সেহরিসের বাবা কাজী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যে কিউআর কোড আছে এর মাধ্যমে আমি ওয়েবসাইটে সনদ দেখতে পাচ্ছি। তারা দেখতে পাচ্ছে না সরকারি ওয়েবসাইটে। নতুন করে বার্থ সার্টিফিকেট বানানো অনেক সময়সাপেক্ষ। আবার নতুন করে টাকা জমা দিতে হবে। আমি যে ফি দিলাম সে টাকাটি কোথায় গেলো।’
সেহরিসের মা মাহমুদা লীনা বলেন, ‘আমাদের বার্থ সার্টিফিকেট বানানো আছে। কিছুদিন আগে পাসপোর্ট অফিসে গেলে সেখানে কোনোভাবেই ভেরিফিকেশন হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সরকারি খাতায় তার নাম ওঠানো হয়নি। আমাদের জানানো হয়েছে এ বিষয়ে তারা দায়বদ্ধ নয়।’
সেহরিসের মতো এমন ভোগান্তি আরও অনেকের। এ ভোগান্তির সূত্রপাত ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের জেদ থেকে। তার একক সিদ্ধান্ত আর একগুঁয়েমির ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অনেককে।
ভুক্তভোগীরা জানান, এ বিষয়ে কারা কাজ করছে, সমস্যার সৃষ্টি কে করছে তা নিয়ে সরকারের কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে দেখছেন না সাধারণ জনগন।
আরও পড়ুন:
২০২৩ সালের জুন-জুলাই থেকে নিবন্ধনের ফির অর্থ নিজস্ব তহবিলে জমার দাবিতে কার্যক্রম বন্ধ রাখে ডিএসসিসি। এরপর তাপসের একক সিদ্ধান্তে ৪ অক্টোবর নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধনের কাজ শুরু হয়। যদিও বিধিমালায় বলা হয়েছে, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ এর ৭ ধারা অনুসারে রেজিস্টার জেনারেলের দায়িত্ব ও কার্যাবলী বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ বিধিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, সফটওয়্যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও এর মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণের এখতিয়ার রেজিস্টার জেনারেলের।
তবে এসব আইন কানুনের ধার ধারেননি শেখ তাপস। তার আদেশেই আইনবহির্ভূত নিজস্ব সার্ভারে সাড়ে ১০ মাসে দক্ষিণ সিটি থেকে ৭৮ হাজার ৯৫৬টি জন্ম নিবন্ধন এবং ১ হাজার ৪৭১টি মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। যা থেকে আয় হয়েছে ৪০ লাখ ২১ হাজার ৩৫০ টাকা। তবে এ সার্ভার থেকে যারাই সনদ নিয়েছেন তাদেরকেই আবারও নতুন করে সনদ নিতে হবে। যাতে নতুন করে আবারও এসব সাধারণ মানুষকে ব্যয় করতে হবে আরও ৪০ লাখ ২১ হাজার ৩৫০ টাকা। জনভোগান্তির কথা চিন্তা না করে একজন নগরপিতার এমন ক্ষমতার অপব্যবহারকে স্বেচ্ছারিতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘শিশুদের কষ্ট দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ নানা বুদ্ধি কৌশল উদ্ভাবন করে আমি মনে করি এটি তেমনই একটি কৌশল। এর ফলে জনগণ আস্থা হারাচ্ছে যা ভালো লক্ষণ নয়।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘তারা জনগণের ভোটে যেহেতু জয়লাভ করেনি ফলে জনগণের প্রতি কেনো দায়বদ্ধতা ছিল না।’
এদিকে দক্ষিণ সিটির নতুন সিইও বলছেন, ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভার থেকে জন্ম-মৃত্যুসনদ নিয়ে ভোগান্তির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন করে নিবন্ধন করতে এলে ভুক্তভোগীদের অগ্রাধিকার দিয়ে সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
ডিএসসিসি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফি খুব বেশি না। তবে জনগণ যেহেতু একবার ফি দিয়েছে সেহেতু জনগণের ভয়েস রেইজ করার অধিকার আছে। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি জন্ম সনদের সফটওয়্যার যে ডেভেলপ করেছে তা ত্রুটিপূর্ণ ছিলো।’
গত বছরের ৫ আগস্টের আগ থেকেই শেখ তাপস কর্মস্থলে আসা বন্ধ করেন। এরপর ওই বছরের ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের আদেশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি তাদের নিবন্ধনসংক্রান্ত কাজ কেন্দ্রীয় সার্ভারে করতে শুরু করে।





