বিস্তৃত জলরাশির মাঝে দিগন্ত রেখায় সবুজের আলপনা। শান্ত জলরাশির সাথে ভেসে বেড়াচ্ছে শরতের সাদা মেঘের ভেলা। এরমধ্যেই ঢেউ ভেঙে ছুটে চলেছে নৌকা। রয়েছে নানা প্রজাতির পাখির অবাধ বিচরণ।
বর্ষা এলেই, বিশালতা বাড়ে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ চলন বিলের। পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে পুরো বিল এলাকা। বিল ঘিরেই জীবিকা নির্বাহ করেন লাখো মানুষ।
চলনবিল ঘুরে দেখা যায় মাছ ধরার বিচিত্র আয়োজন। বিলের উন্মুক্ত জলরাশিতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন সিরাজগঞ্জের ৩ উপজেলার প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবার। বানের পানি এলেও আগের মত আর দেশিয় মাছের দেখা মেলে না বলে অভিযোগ জেলেদের। রিং জাল, চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জালসহ নিষিদ্ধ সব উপকরণ দিয়ে মাছ শিকার করায় হারিয়ে যাচ্ছে ধোঁদা, গুড়পুঁই, বাছা, ভেদা, টিপপুঁটি ও পানি রুইয়ের মত ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির দেশিয় মাছ।
জেলেরা জানান, বর্ষাকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জাল দিয়ে ডিমওয়ালা মাছ ধরে মেরে ফেলে এ কারণে স্থানীয় জেলেরা মাছ পায় না। এখন ধীরে ধীরে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে চলনবিলে।
চলনবিলে মাছের সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে বিল এলাকার জেলেদের পেশাও। জীবিকার তাগিয়ে অনেক জেলেই এখন শামুক-ঝিনুক ও কাঁকড়া নিধন করছেন।
শামুকের ব্যাপারীরা জানান, সারারাত শামুক ধরে সকালে এগুলো বিক্রি করা হয়।
আরও পড়ুন:
এদিকে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও যত্রতত্র পুকুর খননে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চলনবিলের পানি প্রবাহ। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে মাছ ও জলজ প্রাণি শিকার করায় দেশিয় মাছের উৎপাদন কমার পাশাপাশি প্রভাব পড়ছে বিলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ছোট ছোট পুকুরের মতো করে এখন আর বুঝা যায় না এটা চলনবিল।
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘এ বিলে আগে সারাবছরই পানি থাকতো, প্রচুর মাছ ছিলো। শামুক, ঝিনুক বিভিন্ন রকম জলজ প্রাণী ছিল, এক কথায় জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। প্রাকৃতিকভাবে উজান থেকে পলি এসে বিলের গভীরতা কমে গিয়েছে। এছাড়াও, কিছু মানুষ সৃষ্ট কারণে বিল এক কম বিলুপ্তির পথে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলছেন, দেশিয় মাছ পুনরুদ্ধারে চলনবিলে অভয়াশ্রম তৈরির পাশাপাশি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহীনুর রহমান বলেন, ‘পানির যে স্থায়িত্ব তাতে বর্ষাকালে এখানে পানি প্রবেশ করার একটা বিষয় কাজ করে। প্রশাসন এবং মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
তিন জেলাজুড়ে বিস্তৃত দেশের বৃহত্তম এ জলাভূমির আয়তন গত ৮ দশকে কমেছে প্রায় ৪০৮ বর্গ কিলোমিটার। অপরিকল্পিত ভাবে সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় চলনবিলের আকার যেমন কমছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চলনবিলের পানি প্রবাহে। পাশাপাশি অবাধে মা মাছ ও জলজ প্রাণী নিধন করায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশিয় প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী। পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলনবিলের এ বিপর্যয় এড়াতে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ।