টিকিট কালোবাজারির নতুন কৌশল; জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে বিক্রি হচ্ছে টিকিট

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন
অপরাধ
0

নিয়মিত টিকিট কালোবাজারির কবলে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে। অনলাইনে টিকিট কাটার সুবিধা ব্যবহার করে টিকিটের নতুন জালিয়াতি শুরু করেছে কালোবাজারিরা। বিভিন্ন জনের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে তা দিয়ে টিকিট কেটে বিক্রি করা হচ্ছে সোশ্যাল অ্যাপে ও সশরীরে। কৌশলে বিক্রি করা হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক যাত্রীর টিকিটও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি স্টেশনে টিকিট কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ করছে একটি চক্র। কিভাবে চলছে কালোবাজারি?

জরুরি কাজে ঢাকায় যাবেন শিপন কর্মকার। কয়েকদিন ধরে অনলাইনে চেষ্টা করেও মেলেনি টিকিট। কাউন্টারেও না পেয়ে হতাশ তিনি। শেষমেশ একজনের কাছ থেকে ঢাকাগামী ১৫০ টাকার চট্টলা এক্সপ্রেসের টিকিট কেনেন ৩শ' টাকায়। বিকাশে টাকা পাঠানোর পর মুহূর্তেই টিকিট চলে আসে হোয়াটসঅ্যাপে।

শিপনের মতো এমন দুর্ভোগে পূর্বাঞ্চল রেলে ভ্রমণ করা হাজার হাজার যাত্রী। তাদের অভিযোগ, ১০ দিন আগে টিকিট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় সব রুটের টিকিট। একটি চক্র আগেই রেলসেবা অ্যাপে লগইন করে রাখে, এরপর টিকিট কেটে নেয় বিভিন্নজনের এনআইডি দিয়ে। বিক্রি করে চড়া দামে।

যাত্রীরা জানান, কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলে টিকিট পাওয়া যায় না কিন্তু স্টেশনে ব্ল্যাকের টিকিট অহরহ। এনআইডির সঙ্গে টিকিটের চেকিং ঠিকঠাক না হলে ব্ল্যাকের টিকিট বন্ধ করা যাবে না বলেও জানান যাত্রীরা।

যে পারুল বেগমের এনআইডি দিয়ে কাটা টিকিটে ভ্রমণ করেন শিপন তার দেখা মেলে বিজয়নগরের কাঞ্চনপুর গ্রামে। তার দাবি, গত ৫ বছরেও ট্রেনে ভ্রমণ করেননি। ফটোকপির দোকান থেকেই এনআইডির কপি পেয়েছে কালোবাজারিরা- এমন শঙ্কা তার।

এনআইডি জালিয়াতির শিকার পারুল বেগম বলেন, ‘পাঁচ বছরে আমি ঢাকা যাই নি তাহলে আমি টিকিট কিভাবে কাটবো?’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা, আখাউড়া ও আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কালোবাজারির নিয়মিত চিত্র। যা নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশ ফেরত এক ব্যক্তি। তার এজেন্টরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আজমপুর ও কসবা স্টেশনে প্রতিদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটের অন্তত ২শ' টিকিট বিক্রি করেন। কসবা স্টেশনে কালোবাজারির সময় টিকিটসহ ধরা পড়ে তার দুই এজেন্ট।

আখাউড়া রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস. এম. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা প্লাটফর্মে টিকিট বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে আমরা সবসময়ই কঠোর অবস্থানে আছি। কোনোভাবেই যেন প্লাটফর্মে বা কালোবাজারি টিকিট বিক্রি করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা সচেতন আছি।’

পুলিশ জানায়, পরিচিতজন ছাড়াও আশপাশের গ্রামবাসীর এনআইডি নাম্বার নিয়ে প্রতিনিয়ত টিকিট বেচাকেনা করছে এই চক্রটি। কসবার বুগীর গ্রামের সোহেরা বেগম তেমনই একজন। জীবনে কখনোই ট্রেনেই ওঠেননি তিনি। নেই স্মার্টফোনও। অথচ তার এনআইডি ব্যবহার করে অ্যাপের মাধ্যমে কাটা টিকিট বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে।

আর সদর উপজেলার কোড্ডা গ্রামের রেজাউলের ঘটনাটি একটু ভিন্ন। কালোবাজারিরা তার এনআইডি নম্বর ব্যবহার করলেও ব্যবহার করেছে ভিন্ন নাম। তাই রেলসেবা অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না তিনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা, আখাউড়া ও আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কালোবাজারি চক্রে সক্রিয় অন্তত ৩০ জন। কালোবাজারে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার টিকিট বিক্রির তথ্য মিলে অনুসন্ধানে। দ্বিগুণ দামে টিকিট বিক্রির পর চলে ভাগ-বাটোয়ারা।

তবে আগে আখাউড়ার দুই কালোবাজারিকে টিকিট দিলেও এখন টিকিট বিক্রি করেন না বলে দাবি চক্রের মূলহোতার।

আরও পড়ুন:

তানভীর আহমেদ পাঠান ওরফে রাজীব পাঠান বলেন, ‘আমি কখনোই টিকিট বিক্রি করিনি। আগে সোহেল ভাই ছিলো তখন মাঝে মাঝে দিতাম এখন উনি বিদেশ চলে গেছে। আমার সঙ্গে তার কথা হয় না।’

স্টেশন মাস্টারের দাবি প্ল্যাটফর্মের বাইরে টিকিট কালোবাজারির দায় রেলওয়ের নয়। আর চক্রের হোতাকে নজরদারিতে রাখার কথা জানান ওসি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী মাস্টার মো. সাকির জাহান বলেন, ‘এটা আমার স্টেশনে না। যার আইডি সে ই টিকিট কাটছে। সার্ভার তো আর দেখছে না কে ব্ল্যাকার আর কে আসল।’

আখাউড়া রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস. এম. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমিসহ জেলা ডিবি গোয়েন্দা পুলিশসহ আমরা তাদের বিষয়ে কাজ করছি।’

রেলের টিকিটের অনিয়ম ও কালোবাজারি ঠেকাতে ২০১২ সালে চালু করা হয় ই-টিকিটিং সিস্টেম। অপরাধ করলেও সহজেই জামিন পেয়ে আবার চলে কালোবাজারি। তাই কঠোর আইন প্রণয়নের পরামর্শ আইনজীবীদের।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ. কে. এম. কামরুজ্জামান মামুন বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারিকে ট্রায়াল পর্যন্ত আটকে রাখেন। তাহলে তো তার একটা শাস্তি হবে যে হাইকোর্টে গিয়ে জামিন আনতে হয়। অতএব জিনিসটা আমরা না করি।’

ভোগান্তি কমাতে তৈরি করা হয়েছিল অনলাইন টিকিট সিস্টেম। আর তা তৈরিতে খরচ হয়েছে জনগণেরই টাকা। অথচ সেই জনগণই এখন সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে। হাতে একটা ফোন, কিছু এনআইডি আর কিছু মানুষের সহযোগিতা থাকলেই এখন যে কেউ হয়ে উঠতে পারে এই টিকিট নিয়ন্ত্রণের রাজা।

ইএ