মহাজনের উচ্চ সুদের ঋণে নিঃস্ব অনেকে

মুদ্রাবাজার
অর্থনীতি
0

প্রয়োজনের সময় ৫৫ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে ধার নিয়ে শোধ করতে হয়েছে ৫ লাখ টাকারও বেশি। মহাজনের জালে আটকে কয়েক শতকে নিঃস্ব ও সর্বশান্ত হয়েছে অনেক পরিবার। নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় নেই কেনো নজরদারি। সেই সঙ্গে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা খুলনার কপিলমুনির স্কুল শিক্ষক নিহার রঞ্জন বিশ্বাস। এখন তিনি নিঃস্ব ও সর্বশান্ত। দিন কাটছে মানসিক অবসাদে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ৫৫ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে ধার নিয়েছিলেন করোনা মহামারিতে। কোনো কোনো মাসে কিস্তি দিতে না পারাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে সুদের পরিমাণ।

মাত্র ৫৫ হাজার টাকা সুদ, সুদের সুদ ও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ টাকারও বেশি। যা ঋণ নিয়েছিলেন, তা পরিশোধ করতে গিয়ে খুইয়েছেন জমিজমাসহ সব সম্পত্তি। মহাজনের জালে আটকে নিঃস্ব পরিবারটি এখন একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছে।

নিহার রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, 'চেক স্ট্যাম্পের মাধ্যমে দু'টি চেক ও একটি ৩০০ টাকা দারমর স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সে এই টাকা আমাকে ধার দেয়। তারপর সে আমাকে বললো দিন ১০ টাকা হরে এর সুদ দিতে হবে। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে ৫০০ টাকটাকা সে আমার কাছে থেকে নিয়েছে ৫ লাখ।'

|undefined

সুদে ঋণ নিয়ে বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে নিহার রঞ্জন বিশ্বাসকে। ছবি: এখন টিভি

একই অবস্থা পাশের লতা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য কৃষ্ণ রায়ের। মহাজনের কাছ থেকে চেক স্ট্যাম্পের বিনিময়ে মাত্র চার হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এখন তিন লাখ টাকার মামলার আসামি হয়েছেন।

কৃষ্ণ রায় বলেন, 'আমার নামে ৩ লাখ টাকার মামলা দেওয়া হয়েছিল। আমার নামে কোনোদিন নোটিশও আসেনি। এরসট ওয়ারেন্ট বের হইছিল আমার নামে।'

কয়েকশ' বছরের এই বঙ্গে বণিকদের ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বন্ধকী বা সুদের বিনিময়ে ধরের লেনদেন। যুগের পর যুগ প্রয়োজনে পরে মহজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে অনেককেই। কিন্তু পররর্তীতে শোধ দিতে না পেরে চক্রাকার সুদের কারণে সবকিছু হারিয়েছেন অধিকাংশ মানুষ। বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহর সবজায়গাতেই এই বন্ধকীর মারপ্যাচে বন্দী রয়েছে অনেকেই।

স্তানীয় একজন বলেন, '৩ মাস মেয়াদী ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম, প্রতি মাসে ৬০০ টাকা ইন্টারেস্ট করে দিয়ে এ টাকা শোধ করতে হবে।'

বন্ধকী প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংকের অর্থের যোগান দেয় চড়া সুদে। এরা মূলত ব্যক্তি পর্যায়ের অর্থের যোগানদাতা। অনেকেই অলস পড়ে থাকা টাকা সুদের বিনিময়ে বন্ধকী ব্যবসায়ীদের কাছে দিয়ে রাখেন। যার মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।

একজন ব্যবসায়ী বলেন, 'মানুষের মধ্যে এগুলো আছে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের ভেতর এই সুদের টাকা লেনদেন এর বিষয়টা বেশি আছে।'

|undefined

ঋণের টাকা শোধ করতে গিয়ে সবকিছু হারানোর কথা কান্নাভেজা চোখে এখন টিভিকি বলছেন। ছবি: এখন টিভি

চক্রবৃদ্ধি মুনাফার বেড়াজাল ছাড়াও আরও বিড়ম্বনার কথা জানা গেছে বন্ধকীর বাজার ঘুরে। নির্ধারিত সময়ে ধারের টাকা দিয়েও প্রতারিত হয়েছেন অনেকে। হারিয়েছেন নিজের রেখে যাওয়া অলংকার। অনেকক্ষেত্রে পাওনা শোধ করার পরও ফেরত দেয়া হয় না স্ট্যাম্প ও চেক।

স্থানীয় একজন বলেন, 'টাকা যখন দিতে না পারে বা তাদের কোনো ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে সে টাকা টাকা নিজের ইচ্ছামতো চেকের মাধ্যমে মানুষের কাছে টাকা আদায় করে থাকে।'

এসব নানা সমস্যার কারণে বন্ধকীর ব্যবসা অনেকটাই কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। যেখানে আগে দিনে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা একটি দোকানে লেনদেন হত, তা নেমে এসেছে অর্ধেকে। সেই সঙ্গে বছরে কয়েক শত কোটি টাকা সুদের এই বাজারের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। কারণ এই ব্যবসার নির্দিষ্ট তথ্য এবং হিসাব কোনো সরকারি সংস্থার কাছে নেই।

|undefined

নিয়মিত এসব প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও তা সামান্য বলছেন ব্যবসায়ী সমিতির দায়িত্বরতরা ।

কপিলমুনি স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ সরকার বলেন, 'একটা মার্কেটে দুই- চারজন খারাপ থাকতে পারে। এরা হয়তো রাখে। এর পরিমাণ খুবই কম।'

বন্ধকী ব্যবসার বৈধতার বিষয়ে সঠিক কোন নির্দেশনা নেই। নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন। তাই এসব ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসাকে কঠোর নজরদারিতে রাখার তাগিদ স্থানীয় ইউপি সদস্যদের।

লতা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য বিজন কুমার হালদার বলেন, 'এটা আসলে অনেক ভয়ঙ্কর। ১০ টাকা সুদের হার আমাদের মতো মানুষের দেওয়া সম্ভব হয় না।'

লতা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য কুমারেশ মন্ডল বলেন, 'এই সুদ ব্যবসায়ীদের প্রতি আমি কঠোর হওয়ার জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে বিনীত আবেদন রাখবো।'

|undefined

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. রুমুনা হক। ছবি: এখন টিভি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. রুমুনা হক বলেন, 'সুনির্দিষ্ট একটা নীতিমালার অভাবে তারা এ সমস্যায় পরছে। নীতিমালা থাকলে তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীতা আসতো। সরকার এটা জানলে এর উপর ভিত্তি করে আয়কর আরোপ করতে পারবে। এর মাধ্যমে সরকারও কিছু রাজস্ব আয় হতে পারে।'

বর্তমানে বন্ধকি ঋণের বিপরীতে মাসে ৩ থেকে ৫ শতাংশ এবং বছরে ৩৬ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হয়। যা কোনো আইন বা নীতির আওতায় নেই।

উচ্চ সুদের ঋণের কারণে কেউ কখনও খুব একটা সুবিধা করতে পরেনি। ব্যক্তি থেকে ব্যবসা সবকিছু হারিয়েছে এই উচ্চ সুদের ঋণের কারণে। তাই ব্যংক থেকে সহজে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। সেক্ষেত্রে সরকারে রাজস্ব আহরণের নতুন ক্ষেত্র তৈরি এবং নজরদারি বৃদ্ধি এ নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসা বলে প্রয়োজন মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এসএস