জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর: ময়মনসিংহে ন্যায়বিচার নিয়ে সংশয়ে শহিদ পরিবার

প্রতিদিন শহিদ ছেলের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন বাবা
দেশে এখন
0

জুলাই অভ্যুত্থানের বছর পেরোতে চললেও প্রাপ্তির খাতায় কতটুকু যোগ হলো আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন? ১৯ এবং ২০ জুলাই ময়মনসিংহ জেলায় শহিদ হন ৫ জন। আহতদের চিকিৎসা থেকে শুরু করে বিচার প্রক্রিয়া সবক্ষেত্রেই যেন কালবিলম্ব। আদৌ ন্যায়বিচার পাবেন কী না তা নিয়ে হতাশ শহিদের পরিবারগুলো। তবুও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আর যেন কোন স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠে এমন প্রত্যাশা তাদের।

জুলাইয়ের বৃষ্টিতে ভেজা সি কে ঘোষ রোডে, সবার গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া। কিন্তু, তাড়া নেই ছেলের শোকে কাতর শহিদ সাগরের বাবার। এ পথেই নিথর পড়েছিলো তার সন্তান। গত বছরের আজকের দিনে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষ হয় ছাত্রজনতার। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন রিদওয়ান হোসেন সাগর। আহত হন প্রায় অর্ধশত।

শহিদ সাগরের বাবা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি যখন বাসায় ঢুকছি তখন দেখি সে বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন আমি একটা কাজের কথা বললে সে আমাকে বলে আগামীকাল করে দিবে। এটাই ওর সাথে আমার শেষ কথা।’

৫ জুলাই ময়মনসিংহে গোপনে বৈঠক করে আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরিকল্পনা মতো ৬ জুলাই মিছিল নিয়ে টাউনহল মোড়ের উদ্দেশ্যে বের হন তারা। পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হয় আন্দোলন। রেল পথ অবরোধ করে আন্দোলন চলে দিনের পর দিন। প্রথম দিকে জনসমাগম কম থাকলেও ১৬ তারিখের পর স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়। ১৬, ১৭ ও ১৮ জুলাই প্রশাসন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক দলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ২০ থেকে ৩০ হাজার ছাত্র জনতার মিছিলে-স্লোগানে ছেয়ে যায় গোটা ময়মনসিংহ।

জুলাই সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্ট ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি আব্দুল্লাহ আল নাকিব বলেন, ‘ময়মনসিংহে আন্দোলন শুরু হয় মূলত ৬ তারিখ থেকে। এর আগে ৫ তারিখ রাতে আমরা একটি গোপন বৈঠক করি। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে ৬ তারিখ আমরা আনন্দমোহন কলেজের সামনে একটি মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করবো।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ময়মনসিংহের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘এ সরকার গণঅভ্যুত্থানকে কতটা ধারণ করে তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। তুলনামূলক শক্তিশালী গোষ্ঠীকে অধিষ্ঠিত করার দিকে এগিয়েছে এ সরকার। শেখ হাসিনা দীর্ঘ দিনের যে ফ্যাসিজম কায়েম করেছিলো তার প্র্যাকটিস একটা গোষ্ঠী এখানে করেছে ৫ তারিখের পর। যার কারণে আমাদের অভ্যুত্থানের চেতনা ভুলণ্ঠিত হয়েছে।’

তবে, ১৯ জুলাই সবচেয়ে ভয়াবহ দিনের সাক্ষী হয় জেলাবাসী। কারফিউ উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল বেড় করে ছাত্রজনতা। সেদিন জেলার বিভিন্ন স্থানে গুলি করে হত্যা করা হয় হয় ৪ জনকে। তবে, ১ বছরে মূল্যায়নে অনেকটাই হতাশ ছাপ জুলাই যোদ্ধা ও স্বজনদের কণ্ঠে।

জুলাইয়ে আহত রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, ‘কারফিউ জারির পর আমি আত্মগোপনে চলে যাই। ২১ জুলাই রাতে ময়মনসিংহ ডিবি পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে গুলি করে। এখনো আমার পিঠে ক্ষত রয়ে গেছে।’

নাজমুস সাকিব বলেন, ‘যে স্পিরিট নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছিলাম সেটাকে আমরা শতভাগ ধরে রাখতে পারছি কি না এ বিষয়ে জুলাই এর নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাচ্ছি।’

গৌরীপুরে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের কলতাপাড়া বাজারে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে ১৯ জুলাই সকালের নাস্তা খাওয়ার বাহানায় মায়ের আঁচলের গিট খুলে ৫০ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় বিপ্লব হাসান। এর পর সন্তানের মৃত্যুর খবর পায় পরিবার।

বিপ্লবের বাবা মা বলেন, ‘আমাদের ছেলে যে দেশ চেয়েছিলো, যে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে ওইরকম দেশ আমরা এখনো পাইনি। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। সবাই আমাদের ছেলের জন্য দোয়া করবেন।’

সাগর বিপ্লবের মতো ১৯ ও ২০ জুলাই জেলায় শহিদ হন নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব, জুবায়ের আহমেদ ও সাইফুল ইসলাম।

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর রাজধানী জুড়ে লাখো মানুষের উল্লাস মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। ময়মনসিংহের টাউন হল পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। মিছিল স্লোগানে ছড়িয়ে পড়ে নতুন স্বাধীনতার বার্তা।

ইএ