জুলাইয়ের সেই দিনগুলো: আন্দোলন ধামাচাপা দিতে দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ

জুলাই আন্দোলনে শাহবাগ মোড়ে ছাত্র জনতা ও পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান
দেশে এখন
0

জুলাই আন্দোলনে গণমাধ্যম, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার যোগাযোগ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করার মাধ্যমে। ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে প্রশাসনের নগ্ন হস্তক্ষেপ ছিল ওপেন সিক্রেট।

আবু সাঈদের মৃত্যুর পর উত্তাল সারা দেশ। এর উত্তাপ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও দুর্বার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক একটি মৃত্যুর খবর যেন আন্দোলনে যোগ করছিল নতুন মাত্রা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ১৯ জুলাই সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় পতিত সরকার।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার আশরাফুল আমিন বলেন, ‘যেসব এলাকায় সংঘর্ষ বেশি ঘটেছে, গোলাগুলি বেশি হয়েছে, ছাত্ররা বেশি আহত হয়েছে সেসব এলাকায় দেখা যেত ভিপিএন ও কাজ করতো না।’

ইন্টারনেট বন্ধে যেন অকেজো হয়ে পড়ে সংবাদ পাওয়ার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম মুঠোফোনটি। অচল হয়ে যায় ডিজিটাল গণমাধ্যমগুলো। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোও পড়ে বিপাকে।

চ্যানেল ২৪-এর অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর মাকসদ-উন-নবী বলেন, ‘মানুষ তো প্রতি মুহূর্তের আপডেট জানতে চাচ্ছে। কিন্তু মানুষকে সেই আপডেট জানানোর জায়গাটা আমাদের বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলো। আমরা সময়মত দিতে পারিনি সংবাদগুলো। সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রেশার আসতো। সন্ধ্যার ৭টার নিউজে আমাদের যে প্রধান সংবাদ সে সংবাদের আগে আমাদের একধরনের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ নির্দেশনা আসে যে আমরা কোনো সংঘর্ষের সংবাদ চালাতে পারবো না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বলতে হবে দুর্বৃত্ত কিংবা দুষ্কৃতিকারী কিংবা বিশৃঙ্খলাকারী। সরকারের কেউ যদি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাহলে নাম বলা যাবে না, বলতে হবে দু’পক্ষের সংঘর্ষ।’

এর আড়ালে চলতে থাকে ব্যাপক সংঘর্ষ ও হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু জানার কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র ভরসা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতেও তখন চলছে সরকারে কঠোর সেন্সরশিপ। সংঘর্ষ, আহত-নিহতের খবর প্রকাশে ছিল শেখ হাসিনা সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ।

যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘আমাকে হয়তো ফোনে বলা হয়েছে এটা দেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে আমি নিউজরুমকে বলতাম ছোট করে হলেও দেন। তারপর দেখা যেত আবার ফোন আসতো, হুমকি দিত তখন আবার বন্ধ করতাম। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতাম যে একই ঘটনা হয়তো ঢাকার বাইরে ঘটেছে তা দিয়ে একটু রিপ্লেস করা যায় কি না।’

দেশের সবশেষ পরিস্থিতি জানতে তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকা সাধারণ মানুষের তখন একমাত্র ভরসা দৈনিক পত্রিকাগুলো। প্রযুক্তির ধাক্কায় জৌলুশ হারানো এই সংবাদ মধ্যম যেন প্রাণ ফিরে পায়। চাহিদা বেড়ে ১০ টাকার পত্রিকা তখন বিক্রি হয়েছে শত টাকাতেও। তখন পত্রিকাগুলোতেই পাওয়া যেত আগের দিনের প্রাণহানির খবর।


শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা অনলাইনভিত্তিক সবকিছু করতাম কিন্তু পত্রিকাগুলো দেখতাম নিয়মিত। কোথায় কতজন মারা গেছেন, কতজন আহত হয়েছেন, কোন জায়গায় আক্রমণ বেশি হচ্ছে এসব খোঁজ রাখতাম।’

পত্রিকা বিক্রেতারা জানান, ওইসময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে পত্রিকার চাহিদা বেশি ছিলো।

এদিকে আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেট শাটডাউন সবচেয়ে বেশি বিপাকে ফেলে আন্দোলনকারীদের। এক পর্যায়ে ইন্টারনেট চালু রাখা হলেও বন্ধ রাখা হয় ফেসবুক, ইউটিউবসহ বেশকিছু সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। স্তিমিত হওয়ার আশঙ্কা জাগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ই সংগঠিত হওয়া এই গণআন্দোলন।

সাদিক কায়েম বলেন, ‘যখন ইন্টারনেট চলে গেলো তখন আমরা বুঝতে পারছিলাম না, কী করবো।’

তবে বিষয়টি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরে বেশ কিছু বাটন ফোন ও সিম কিনে রেখেছিলেন আন্দোলনকারীরা দাবি-দাওয়া প্রকাশ, প্রেস রিলিজ পাঠানো এবং সমন্বয়ক ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এর মাধ্যমেই।

জুলাই আন্দোলনের সংগঠক সাদিক কায়েম বলেন, ‘ওইসময় আমরা আমাদের বিকল্প সিমগুলো ও বাটন ফোনের মাধ্যমে একটি অফলাইন নেটওয়ার্ক তৈরি করলাম। প্রতিনিয়ত ওইসময় আমাদের শহিদ হওয়ার কথা। আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম শহিদ হওয়ার জন্য।’

তবে জুলাই আন্দোলনের এ সংগঠক জানান, শত প্রতিকূলতার মাঝেও আন্দোলন চালিয়ে যাবার শক্তি জুগিয়েছিল শহিদেরা।

১৯ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধের পর ৫ তারিখের আগ পর্যন্ত পুরোদমে ইন্টারনেট আর চালু করেনি সরকার। ২৩ জুলাই সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করলেও মোবাইল ইন্টারনেট সচল করা হয় আরও ১০ দিন পর। তবে বন্ধ রাখা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। ৪ তারিখ আবারো বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট।

ইএ