বিদেশে নারীকর্মী নির্যাতন: পাঁচ বছরে পাড়ি জমিয়েছেন পৌনে চার লাখ, ফেরার হিসাব নেই

বিদেশে যাওয়া নারীকর্মীদের অনেকেই বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছেন
দেশে এখন
0

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নারীকর্মী পাঠানোর সর্বোচ্চ তালিকায় রয়েছে গৃহকর্মী, শিশু পরিচারিকা, রাঁধুনি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পেশা। আর এসব পেশায় গিয়েই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হন তারা। পাঁচ বছরে বিভিন্ন দেশে গেছেন প্রায় পৌনে চার লাখ নারীকর্মী। তবে তাদের কতজন দেশে ফিরেছেন এ হিসাব সংরক্ষিত না থাকলেও, নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়ান অনেকেই।

ঢাকার জুরাইনের ডালিয়া, স্বামী ও পরিবারের জোরাজুরিতে হয়েছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। গৃহকর্মী পেশায় দেশটিতে যাবার পর শুরু হয় নির্যাতন। কখনো ভাষা না জানায়, কখনো দক্ষতার প্রশ্নে মারধরের শিকার হন তিনি।

কর্মস্থল পরিবর্তনের পর সামনে আসে আরও দুর্বিষহ অধ্যায়। মালিক পক্ষের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। কখনো বাবা, কখনো ছেলের হাতে নির্যাতিতা এ কর্মী নিজেকে বাঁচাতে জানালা ভেঙে ঝাঁপ দেন, ভেঙে যায় মেরুদণ্ডের হাঁড়।

যে স্বামীর অনুপ্রেরণায় প্রবাসী হয়েছিলেন, এসময় তিনিও ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে হাঁটাচলা করতে পারলেও ভবিষ্যৎ আঁধারে ঘেরা প্রবাস ফেরত এ নারীকর্মীর।

ডালিয়া বলেন, ‘আমার পরিবার আমাকে পাঠিয়েছিল। তারা বলেছিল, ভালো হবে, যেতে। এখন গিয়ে তো ভালো হয়নি, আসার পরে এখন আর তারাও মেনে নিচ্ছেন না। আমার স্বামীর সঙ্গে এখন আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আমার ছেলেটাকে তারা রেখে দিয়েছে।’

মানিকগঞ্জের তারা মিয়া স্বচ্ছলতা ফেরাতে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন জর্ডান। গৃহকর্মী পেশায় সেখানে যাওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মেয়ের খোঁজে কখনো দালালের বাড়ি, কখনো থানায় যান তারা মিয়া। বছরখানেক পর যখন খোঁজ পান, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দেশটি থেকে এ নারীকর্মী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ফেরেন। কয়েক মাস পর কোলে আসে কন্যা সন্তান। ধীরে ধীরে ওই সন্তান বড় হতে থাকলেও পিতৃ পরিচয়ের অভাবে এখনো জন্মনিবন্ধনও করাতে পারেন নি তারা।

নারী কর্মী বলেন, ‘চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছেও গিয়েছি। তারা বলছে, এটা আমরা পারবো না কেস খাবো। এখন আমি আমার ভবিষ্যৎ তো দূরের কথা, আমি বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছি।’

আরও পড়ুন:

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে বহির্বিশ্বে ৩ লাখ ৮০ হাজারের মতো নারীকর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এ সময়ের মধ্যে তাদের কতজন দেশে ফিরেছেন, সে তথ্য সংরক্ষিত নেই।

ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ওয়্যারবির পরিচালক জাছিয়া খাতুন বলেন, ‘এখন এই ডাটা থাকলে যে সুবিধাটা হতো তা হলো, আমাদের কিন্তু অনেকেরই এরকম প্রোগ্রাম আছে যে, এই সোশালটাকে কাউন্সেলিং করাবে।’

চলতি বছরেও প্রবাসে গেছেন ৫০ হাজারের বেশি নারীকর্মী। সর্বোচ্চ তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, জাপান ও কাতার। বিগত বছরগুলোতে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও ছিল এই তালিকায়। গৃহকর্মী, শিশু পরিচারিকা, রাধুনি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে গেছেন এদের প্রায় ৩৫ হাজারের বেশি কর্মী। নারীকর্মী বিদেশ পাঠাতে খরচ কম হলেও তাদের পরিশ্রম ও ক্ষতির সম্মুখীন হবার ঝুঁকি থাকে বেশি।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট পরিচালক মেরিনা সুলতানা বলেন, ‘মিডেলইস্ট কেন্দ্রিক যে এক ধরনের সার্ভিস এবং এক ধরনের স্টিগমা তৈরি হয়ে রয়েছে, সেটাকেও আমার মনে হয় যে, ইনস্টিটিউশনের উচিত ওই জায়গাগুলোকে ভাঙা। যদি মিডেলইস্ট আমাদের মেয়েদের জন্য সেইফ না হয়, তাহলে সেইফ করার জন্যচিন্তা করতে হবে।’

বৈদেশিক রেমিট্যান্সের সহায়ক এ কর্মীদের ফিরে আসার তথ্য সংরক্ষণসহ দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের শিকার কর্মীদের সরকারিভাবে মনো সামাজিক ও আর্থিক পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে বলছেন অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘নারীরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে ফেরত আসে, অনেক সময় পরিবার তাকে গ্রহণ করতে চায় না। সমাজে তারা বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়। এ বিষয় নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। সেই জায়গাগুলোতে যদি আরও কম্প্রিহেনসিভভাবে এ সাপোর্টগুলো দেয়ার একটা মেকানিজম তৈরি করা যায়, সরকারের জায়গা থেকে!’

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীকর্মীদের বিদেশে পাঠানো আগে কর্মসংস্থানের যথাযথ খোঁজখবর নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ ফিরে আসা কর্মীদের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং করে আয়ের পথ তৈরি করে দিতে হবে।

এসএইচ