ঐতিহ্য হারাচ্ছে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা, নড়বড়ে ভিত

সংস্কৃতি চর্চা ও যথাযথ সংরক্ষণের পরামর্শ

কিশোরগঞ্জ
এখন জনপদে
0

যেই ভাষায় একদিন গাঁথা হয়েছে অসংখ্য লোকগীতি, পালাগান আর সাহিত্যকর্ম, কালের বিবর্তনে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক সে ভাষা হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নড়বড়ে হয়েছে এ ভাষার ভিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঞ্চলিক ভাষা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সংস্কৃতির চর্চা ও যথাযথ সংরক্ষণ।

নাম খোকন বয়াতি, বাড়ি কিশোরগঞ্জ। কাজ করেন পালা গান নিয়ে। নাম খোকন হলেও কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি পরিচিত 'কুকন বয়াতী' হিসেবে। আধুনিক এই যুগে খোকন বয়াতিরাই ধরে রেখেছে আঞ্চলিকতার হাল। তার কাছে শুনবো কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার গান।

খোকন বয়াতি চম্পাবতী, চন্দ্রাবতীর পালায় খোঁজেন কিশোরগঞ্জের মাটির গন্ধ। বয়াতীর গানের টানে উতলা হয়ে ওঠে শ্রোতা মন। যে গান বহন করে মানুষের কথা। কিন্তু সময়ের সাথে যেন তার সুর বদলাচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আধুনিকতা। তবুও বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা তার।

অঞ্চলভিত্তিক ভাষার মধ্যে বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নোয়াখালীর সাথে উঠে আসে বৃহত্তম ময়মনসিংহের ভাষা। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, জামালপুর এলাকার স্থানীয় ভাষায় অন্য রকম এক রস আছে।

বাংলা সাহিত্যের রান্নাঘরের শোভা বাড়িয়েছে এই ভাষা। জেলার এমন অনেক উপজেলা আছে যেখানে আঞ্চলিক ভাষার ভেতরেও রয়েছে নানা ভাগ। যেমন, হাওর উপজেলার অষ্টগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা নিজস্ব এক ভাষায় কথা বলেন, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'ছহুম ভাষা" নামে।

কিশোরগঞ্জের ভাষা কখন বা কিভাবে এসেছে তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে, এই অঞ্চল ছিল হাজরাদি পরগণার আসাম-কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সেসময় কোচ-হাজোং সামন্তরা চালাতো এ এলাকা। তখন থেকেই আদি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও তাদের ভাষার মিশ্রণ ঘটে। পরবর্তীতে যার সাথে যোগ হয় বিভিন্ন সময় আসা মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও বনিকদের ভাষা।

সাহিত্যিক ড. দীনেশচন্দ্র সেন তার মৈমনসিংহ গীতিকায় এই ভাষার অনেক মজার বিষয় তুলে ধরেছিলেন। ড. সেন হারানো গীতিকা সম্পদকে উদ্ধার করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে সারা দুনিয়ায় এই অঞ্চলকে পরিচিত করেছেন।

তার চুয়াল্লিশটি গীতিকার ভেতর ত্রিশটিই পূর্ব ময়মনসিংহের। এছাড়া, কিশোরগঞ্জের মেয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর 'দস্যু কেনারামের পালা' বা 'মলুয়া'র মত অমর কিছু সৃষ্টি শক্ত করেছে বাংলা সাহিত্যের ভিত। হালের জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীদের মুখেও এ জেলার আঞ্চলিক রস ফুটে ওঠে।

বর্তমান যুগের তরুণদের মাঝে পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাব বাড়ার সাথে সাথে কমতে শুরু করেছে আঞ্চলিক ভাষাপ্রীতি। প্রমিত ভাষায় কথার চর্চায় তারা ভুলতে বসেছে আঞ্চলিকতার ফোঁড়ন। খাঁটি আঞ্চলিকতা যেন অবসর যাপনে প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো এক রান্নাঘরে।

ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের প্রমিত ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার যথাযথ শিক্ষা প্রয়োজন। এই ভাষা যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য প্রয়োজনদের তরুণদের মাঝে এ ভাষার চর্চা।

এএইচ