হাওরাঞ্চলে বাড়ছে বজ্রপাত, আতঙ্কে এলাকাবাসী

কিশোরগঞ্জ
হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন কৃষক, জেলে, পথচারী
এখন জনপদে
0

হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন কৃষক, জেলে, পথচারী। প্রতি বছর প্রাণহানির পরও স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেই জেলা বা জাতীয় পর্যায়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাত বেড়েছে বহুগুণ। তবুও জেলার কোথাও নেই বজ্র নিরোধক দণ্ড, নেই আগাম সতর্কতা।

২০১৬ সালের মে মাসে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে আজ ও দেখা যায়নি তেমন কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম জেলার মোট আয়তনের ৪৬ শতাংশজুড়ে থাকা এই তিন হাওর উপজেলায় নেই কোনো বজ্রনিরোধক দণ্ড ও আশ্রয়কেন্দ্র। কিছু স্থানে এসব দণ্ড স্থাপন করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট কিংবা চুরি হয়ে গেছে।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করেন তারা। ধান কাটার সময় বৃষ্টিতে বজ্রপাতে লোকজন মারা যায় বেশি। এই ভয়ে এই এলাকায় এখন ধান কাটতে আসতে চায় না মানুষ।

চলতি বছরের ৬ মে বেলা ১২টা নাগাদ পরীক্ষায় অংশ নিতে স্কুলে যাচ্ছিলো চরটেকি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী বর্ষা এবং দুই সহপাঠী ইরিনা ও প্রিয়া। হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে আসে, বজ্রপাতের শিকার হলো তিনজন। দুই বান্ধবী ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বর্ষা বেঁচে গেলেও তার শরীরের ডানপাশ পুড়ে যায়। এখনো হাসপাতালের বিছানায় লড়ছে সে। এমনকি জানেও না, তার প্রিয় দুই বান্ধবী আর বেঁচে নেই।

বর্ষা জানান, স্কুলে যাওয়ার সময় বান্ধবীকে ডাকতে গিয়ে না পেয়ে তাকে ছাড়াই দু’জন স্কুলের উদ্দেশে রওনা দেন। এরপরের আর কিছুই তার মনে নেই। স্বজনদের প্রার্থনা, সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারে আগের জীবনে।

কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ৫ বছরে জেলায় বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১০০ জন। আহত ১৫ জন। এদের মধ্যে ৮৮ জন পুরুষ, ১২ জন নারী। পেশাভিত্তিক হিসাবে ৭৭ জন কৃষক, ১৫ জন শিক্ষার্থী এবং ৮ জন গৃহিণী। তবে এ মৌসুমে কেবল এপ্রিল-মে মাসেই বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন।

প্রতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও কর্তৃপক্ষের নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। হাওর উপজেলা নিকলিতে জেলার একমাত্র আবহাওয়া অফিসেও নেই বজ্রপাতের আগাম সংবাদ পাওয়ার কোনো পরিমাপক যন্ত্র।

নিকলী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার ফারুক বলেন, ‘নিকলি আবহাওয়া অফিসে বর্তমানে বজ্রপাত অ্যালার্মিংয়ের কোনো সিস্টেম নেই। তবে ভবিষ্যতে ইনস্টল করার পরিকল্পনা রয়েছে। যখন হবে তখন এলাকাবাসী অবশ্যই উপকার পাবেন৷’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণেই বাড়ছে বজ্রপাত। যেহেতু খোলা হাওরে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে, তাই সর্বসাধারণকে আরো সতর্ক হবার পরামর্শ তাদের।

গুরুদয়াল সরকারী কলেজ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শামসুল আলম সাগর বলেন, ‘উঁচু বিল্ডিং রয়েছে এমন স্থানে বজ্রনিরোধক দেয়া হলে সেখানেই সেগুলো টাচ করে আর মাটিতে যাবে না।’

জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ অধিদপ্তর থেকে বজ্রপাতে নিহত প্রতিটি পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও, প্রচারের অভাবে অনেকেই তা জানেই না।

কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও দূর্যোগ কর্মকর্তা মো. বদরুদ্দোজা বলেন, ‘বজ্রপাতে লোক মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা ২৫ হাজার করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকি। বজ্রপাত নিরোধকের কোনো কার্যক্রম এখানে চালু নেই। এটা যদি টেকনিক্যালি কার্যকর হয়, তাহলে চালু করা উচিত।’

জেলায় নিরোধক যন্ত্রের খুব একটা দেখা না পাওয়া গেলেও গত ১১ মে হোসেনপুরের কুড়িঘাট এলাকায় শহীদ মিনারের পাশে বজ্রনিরোধক দণ্ডটির কারণে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন ষাটোর্ধ্ব কৃষক আবু বকর, দাবি পরিবার ও এলাকাবাসীর। আশপাশের লোকজন বলছেন, বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়েছিল এবং সেই স্থানে ছিল আবু বকর। কিন্তু দণ্ডটি থাকায় তা টেনে নিয়ে গেছে। নাহলে হয়ত তাকে আজ জীবিত পাওয়া যেতো না। তাদের দাবি, এরকম নিরোধক দণ্ড যদি বেশি করে স্থাপন করা হয়, কমতে পারে মৃত্যুর সংখ্যা।

ইএ