১৯৭১ সালের ১৩ জুন, দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় সৈয়দপুর স্টেশনের এই প্লাটফর্মে একটি ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। সেই ট্রেনে চড়ে বসেন সৈয়দপুরের বেশ কিছু মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবার। উদ্দেশ্য ছিল নিরাপদে ভারতে পৌঁছানো।
কিন্তু ট্রেনের যাত্রীরা জানতেন না যে, কী বিভীষিকা নেমে আসতে যাচ্ছে তাদের জীবনে। প্রায় ২ কিমি চলার পর গোলাহাট নামক স্থানে থামে ট্রেনটি। সেখানে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
৫৪ বছর আগের এই দিনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ৪৪৮ জন মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারকে। সেসময় ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান তপন কুমার দাসসহ ১০ জন।
৪ যুগেরও বেশি সময় পর সেই দৃশ্যগুলো এতটুকুও ঝাপসা হয়নি তাদের কাছে। সিনেমার মতো এখনও চোখের সামনে দেখতে পান নিকট স্বজনদের বলী হতে।
বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী তপন কুমার দাস বলেন, ‘মাটিতে আধা কবর দিয়ে রেখে দিয়েছিল একদম। চুল, হাত এগুলো বেরিয়ে ছিল। পরে আমরা জামা কাপড় দেখে আমাদের পরিবার-পরিজনদের শনাক্ত করেছিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহরের গার্ড পাড়া, রেলওয়ে কারখানাসহ পুরো শহরেই চালিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ। শহরের বুদ্ধিজীবীদের রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল এপ্রিল মাসে। আর জুনে ঘটানো হয় গণহত্যা। হানাদার বাহিনী যার নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন খরচাখাতা’।
ঘটনার দিন সৈয়দপুর শহরে ছিলেন বাবু প্রভাস বিশ্বাস। চাকরি করতেন রেলওয়ে কারখানায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনেক নৃশংসতার সাক্ষী তিনি। বেঁচে যাওয়াদের মুখে শুনেছেন সেদিনকার সেই ট্র্যাজেডির কথা।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শিকার বাবু প্রভাস বিশ্বাস বলেন, ‘মহিলা-বাচ্চারাও চাড় পাননি। সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।’
সিনিয়র সাংবাদিক এম আর আলম ঝন্টু বলেন, ‘অসংখ্য লোক দাঁড়িয়ে, সবাইকে কুপিয়ে শেষ করছিল, বল্লম ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। যারা একটু ছোট শিশু ছিল, তাদেরকে ধোপার মতো রেল লাইনে আঁছড়ে মারছিল।’
নৃশংস এই গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখতে গোলাহাটের বধ্যভূমিতে ২০১৪ সালে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর অযত্ন-অবহেলার ছাপ যেন ফুটে উঠেছে প্রতিটি পরতে পরতে।
মাদকসেবীদের আড্ডাখানায় পরিণত স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানটি। তরুণ প্রজন্ম চাইছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ এই বধ্যভূমিটি যেন বছরজুড়েই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
স্থানীয় যুবকদের মধ্যে একজন বলেন, ‘প্রশাসনকে অনুরোধ করবো যে, সে জায়গাটা দেখাশোনা করা দরকার এবং সার্বিক নিরাপত্তার বিয়য়টিও যেন তারা দেখে।’
এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভাষ্য ছিল, দামি গুলির একটিও খরচ করা হবে না তাদের জন্য।
নিহতদের স্মরণীয় করে রাখতে যে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে তা কেবল ১৩ জুন এলেই মনে পড়ে সবার। নতুন প্রজন্মের দাবি, সারা বছর যেন এই স্মৃতিসৌধটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।