গত এক দশকে কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হোটেল-রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রিক স্থাপনা।
গণপূর্ত বিভাগের হিসেব অনুযায়ী, হোটেল-মোটেল জোনে ২২৬টি হোটেল নির্মিত হয়েছে গণপূর্ত থেকে বরাদ্দ পাওয়া জমির পুরোটা দখল করে। এছাড়াও, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ নেয়া আবাসিক ফ্ল্যাটেও চলছে বাণিজ্যিক হোটেল ব্যবসা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কক্সবাজারে পাঁচ শতাধিক হোটেল-রিসোর্টের মধ্যে মাত্র ১২টি হোটেলের নিজস্ব স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে। বাকিগুলোর পয়ঃবর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে খাল-নালার মাধ্যমে সাগরে।
এসব অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ও ব্যবসার দায় স্বীকার করেছেন হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি নিজেই। অথচ তার পরিচালিত হোটেলেও নেই পূর্ণাঙ্গ এসটিপি। এ কারণে সংগঠনের নেতৃত্বে থেকেও ন্যূনতম পরিবেশ-মানদণ্ড রক্ষা না করায় তার ভূমিকাই এখন প্রশ্নের মুখে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘যেসব স্থাপনা হয়েছে, যেসব হোটেল-মোটেল উঠেছে তাদের বাধ্যতামূলক এসটিপির আওতায় আনতে হবে। যারা সেটা চাইবে না, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ করে দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘শুরুতে কোনো পরিকল্পনা আমাদের হাতে ছিল না। আর সেজন্যই ৫০০টির মধ্যে প্রায় ৩০০ থেকে সাড়ে তিনশো হোটেল নিয়ম না মেনেই তৈরি হয়েছে।’
পরিকল্পনাহীন সম্প্রসারণ এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে পৌরসভাও। কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী পরাক্রম চাকমা বলেন, ‘রাস্তা বা ড্রেন এভাবে আকাবাকাভাবে করলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া এসব হোটেল এতদিন কীভাবে চালু ছিল, সে প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ‘যেসব হোটেলে এসটিপি নেই তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। প্রত্যেক মাসেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে আমাদের পক্ষ থেকে।’
অনিয়মের এখানেই শেষ নয়। সৈকতের ৩০০ মিটারের মধ্যে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গড়ে উঠেছে বহু স্থাপনা। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই বসানো হয়েছে প্রায় ৬০০ ঝুঁপড়ি দোকান।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনার কাজ চলছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যদি একটু স্ট্রিক্ট হলে আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। অন্যথায় এটা সম্ভব নয়।’
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নাঈম মো. তালাত বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই কয়েকটি ফেইজে আমরা এ কার্যক্রম হাতে পাবো।’
দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন পরিকল্পনা না থাকলে কক্সবাজারের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ শাকিফ শামীম বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে যেটা হয় প্রতিটি দালান তৈরির সময় কীভাবে তারা ফরেস্ট ল্যান্ডকে কনজার্ভ করবে সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। আমাদের কক্সবাজারে বা চট্টগ্রাম বিভাগে এত গাছ রয়েছে, যেগুলো আমরা নষ্ট করে ফেলছি হোটেল বা রাস্তার নাম করে। অথচ এটা পুরোপুরি কনজার্ভ করে করা সম্ভব।’
পরিকল্পনার অভাব, দায়সারা মনোভাব আর নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার সব মিলিয়ে পর্যটনের ভারেই আজ নুয়ে পড়ছে কক্সবাজার।