পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্যের রক্তখেলা, লক্ষ্য ‘জুম্মল্যান্ড’

খাগড়াছড়ি
উদ্ধার করা অবৈধ সব আধুনিক অস্ত্র
এখন জনপদে
অপরাধ
1

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বিবর্ণ হয় আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতায়। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটে গোলাগুলির ঘটনা। খাগড়াছড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, এসব এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ সব আধুনিক অস্ত্র। আর এতে গেল এক বছরে সশস্ত্র দলগুলোর সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৫ জন। এছাড়াও, অনেকেই স্বপ্ন দেখেন তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার।

রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গ কিলোমিটার; যা দেশের মোট আয়তনের এক দশমাংশ। এখানে আছে সবুজ বনভূমি, পাহাড় ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য। সঙ্গে যোগ হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সৌন্দর্যের রানি কাপ্তাই লেক। নদী, ডুবো পাহাড় আর ঝর্ণার মিশেলে এই অঞ্চল যেন হয়ে উঠেছে জীবন্ত ক্যানভাস।

প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য বিবর্ণ হয় আঞ্চলিক সশস্ত্র বাহিনীর তৎপরতায়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়শই ঘটে গোলাগুলির ঘটনা। ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ সব আধুনিক অস্ত্র। পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে একে-৪৭ থেকে শুরু করে একে-৫৬, একে-২২, এম-১৬; মার্ক-২ রাইফেল, এম-৪ কার্বাইন, ৪০ এমএম গ্রেনেড লঞ্চার, চায়না রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, এসএলআর, এসএমজি, এলজি, বিমানবিধ্বংসী রিমোট কন্ট্রোল বোমা, গ্রেনেড, হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল ও স্নাইপার রাইফেল। খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণ আর আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করা হয় এসব অস্ত্র।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, গত এক বছরে সশস্ত্র দলগুলোর সংঘর্ষে ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতের বেশি।

অস্ত্রের ঝনঝনাতি মাঝে মধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠে পাহাড়। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুত, চাঁদাবাজি আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীদের অনেকেই স্বপ্ন দেখে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার। সোশ্যাল মিডিয়াতেও দেখা যায় এসব প্রচারণা। তবে সাধারণ পাহাড়িরা জানায়, এ ধরনের তৎপরতায় সমর্থন নেই তাদের।

স্থানীয়রা জানান, সরকার এটা কখনোই দেবে না। পাহাড়ে বাস করা মানুষজনও বাঙালি। এটা এখানে কেউ চায় না। তারা মূলত চায় স্বায়ত্তশাসন। এক কথায় ভারতে যেভাবে প্রদেশগুলো চলছে, এরকম আরকি!

চাঁদাবাজি, অপহরণ আর জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠাসহ নানা ইস্যুতে ফোনে কথা হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমার সঙ্গে। পার্বত্য অঞ্চলে একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা কতটুকু জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।

ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, আপনি যেকোনো নাম দিতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌজার অধীনে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিচালনা করতে হবে। আমাদের কোনো প্রতিরক্ষা নীতি থাকবে না। বাংলাদেশের আপামর জনগণের ওপর যখন কোনো কারণে হামলা হবে, বাইরের শত্রু আক্রমণ করবে তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তুলবে। এজন্য স্থানীয় জনগণের প্রয়োজনীয়তা আছে। তারা তাদের মতো করে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। কিন্তু এমন কোনো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আছে, যেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে না।

আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বন্ধে সজাগ রয়েছে সেনাবাহিনী বিজিবি ও পুলিশ। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে তারা।

সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ অর্থের। আর এই অর্থ যোগানের অন্যতম উৎস পার্বত্য চট্টগ্রামে সেবাদাতা মোবাইল অপারেটরগুলো। একই সঙ্গে ঘটছে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়ার ঘটনা। আর এসব কর্মকাণ্ডে বিরক্ত এলাকাবাসী।

আরও পড়ুন:

সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্যে পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রতিনিয়তই কমছে পর্যটক। ক্ষতির মুখে পড়ছে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প।

খাগড়াছড়ি পর্যটন উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য শাহিদুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘আপনারা যে কথা বলছেন, এটা একদম অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী যে উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটা আমি মনে করি সঙ্গে যদি আরও প্রশাসন যদি উদ্যোগ নেয়; তাহলে আমরা মনে হয় ভালো একটা ফলাফল নিয়ে আসবো।’

তিন পার্বত্য জেলায় ১৯৭৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ৫টি অপারেশন পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রথমটি ছিল অপারেশন ডিগ আউট। দ্বিতীয়টি অপারেশন ট্রাইডেন্ট। তৃতীয় আর চতুর্থ অপারেশনের নাম পাঞ্চিং টাইগার ও অপারেশন দাবানল। আর সবশেষ অপারেশন উত্তরণ শুরু হয় ২০০১ সালের ১ আগস্ট থেকে, যা এখনো চলছে।

ইএ