চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় জাহাজ প্রবেশের পর থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে বন্দর। টাগবোট সার্ভিস, পাাইলট পাঠানো পানি সরবরাহ, ক্রেন চার্জ, জাহাজ ভিড়ানো, কনটেইনার উঠানো নামানোসহ পণ্য ডেলিভারি পর্যন্ত দেয়া হয় প্রায় ৬০ ধরনের সেবা। জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন সেবা ও ভাড়া থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা আয় করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। নীট মুনাফা হয়েছে ২ হাজার ৪২ কোটি টাকা। ব্যাংক বর্তমানে নগদ টাকা আছে সাত হাজার কোটি টাকা।
বর্তমানে ১৯৮৬ সালের ট্যারিফ কাঠামো অনুযায়ী সেবার মূল্য নিচ্ছে বন্দর। সবশেষ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৫টি খাতে সেবার মূল্য বৃদ্ধি করা হয় । এরপর ২০১৩ সালে পুরো ট্যারিফ কাঠামোই যুগপোযোগী করার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। সেসময় এতে সায় না দিলেও ২০১৯ সালে সরকার ট্যারিফ বাড়ানোর অনুমোদন দিলে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে বন্দর। ২০২০ সালে নতুন সেবা মূল্যর প্রস্তাবনা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ছয় বছর পর এটি কার্যকর করতে যাচ্ছে বন্দর।
কর্তৃপক্ষের দাবি, ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়াসহ, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্দরের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সেবার মূল্য অনেক কম। গত তিন যুগে বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ ও পরিচালন ব্যয় বহুগুণে বাড়ায় ট্যারিফ হালনাগাদ করতে হচ্ছে। প্রাথমিক প্রস্তাবনায় ১৮টি সেবার মূল্য বাড়ছে ৬০ শতাংশ, ১৭টি সেবায় বাড়ছে ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ, ১৯টি সেবার মূল্য ২০ শতাংশ করে বাড়ছে। দুটি সেবার মূল্য কমানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার ও মেরিন সদস্য ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বন্দরের পক্ষ থেকে শীপ আসার পর যে সমস্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়, তার বিপরীতে বিভিন্ন রকম চার্জ হয়। যেমন, টার্গেট চার্জ, ওয়াটার চার্জ, ওয়ারফ্রেন্ট চার্জ হয়। আমাদের প্রতিবেশী যেমন শ্রীলংকা বা অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে ট্যারিফ রেট কম। আমাদের ট্যারিফ রেট যদি সকলের সাথে সমান ও রাখতে চাই তাহলে এটা বাড়ানোটা যৌক্তিক।’
নতুন ট্যারিফ কাঠামো জটিল ও ব্যয়বহুল দাবি করে ব্যবহারকারীরা বলছেন, ট্যারিফ বেশি হলে জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া বাড়বে, যা বহন করতে হবে ভোক্তাকেই। ১২ শতাংশের বেশি বাড়ানো অযৌক্তিক বলছেন শিপিং এজেন্টরা।
এমএস সি শিপিং লাইনের মহাব্যবস্থাপক আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ট্যারিফটাকে এত বেশি জটিল ও ক্লোজযুক্ত করা হয়েছে যে এটা একটা বোধগম্য বিষয় আর থাকে না আমাদের কাছে। ব্যয় এত বেশি বাড়ানো হয়েছে ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রত্যেকটা আইটেমকে আনজাস্টিফাইড ভাবে এত বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে যা ট্রেডের জন্য এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বলেন, ‘শিপিং কোম্পানিগুলো তাদের ফ্রেড আইটেমের মধ্যে এই রেট গুলো বাড়িয়ে দিবে। ফলে এগুলো ভোক্তার উপর গিয়ে পড়বে। আমরা এই জিনিস্টা এড়িয়ে যেতে চাই। সেজন্য আমরা এটা বাড়ানোর পুরোপুরি বিপক্ষে।’
ট্যারিফ বাড়ানোর বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ায় প্রতিবছরই সেবার মূল্যও বেশি দিতে হচ্ছে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্দরের আর ট্যারিফ বাড়ানোর সুযোগ নেই।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি এ. এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, ‘২০০৮ সালে যখন ডলারের দাম ছিলো ৭৬ টাকা তখন আমাদের যেই রেটটা করেছে এখন আছে ১২০ টাকা। অর্থাৎ যতবার ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ততবার বন্দরের রেট বৃদ্ধি পেয়েছে। খরচ বাড়ালে কস্ট অব ডুয়িং ভিজিলেন্স বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। এবং আমাদের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে , সবার সাথে আলোচনা করেই ট্যারিফের কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। যা হবে বাস্তবসম্মত।
এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘৩০শে জুন পর্যন্ত তাদেরকে সময় দিয়েছে তাদের মতামত জানার জন্য। এবং এই মতামতগুলো পাওয়ার পর আমরা রিভিউ করবো সবাইকে। গ্রহণযোগ্য আশা করছি একটা সমাধান ও ট্যারিফ রেট যাতে আমাদের বন্দরের অপারেশন্স অ্যাফিশিয়েন্সির বিপরীতে যেই আয়টা হওয়ার কথা সেটা আয় হতে পারে।’