মেঘভাঙা বৃষ্টিতে পাহাড়ে প্রাণহানি শতাধিক; জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায় দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা
পরিবেশ ও জলবায়ু
0

সম্প্রতি পাহাড়ি অঞ্চলে মেঘভাঙা বৃষ্টি বা ক্লাউডবার্স্টের কারণে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস প্রাণ হারিয়েছে কয়েক শ’ মানুষ। আবহাওয়াবিদদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মেঘভাঙা বৃষ্টি সাধারণত এক ঘণ্টার ব্যবধানে ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। খুব অল্প সময়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতে দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস। এ ধরনের ঘটনার পেছনে মূলত বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার জটিল মিথস্ক্রিয়া দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয় ক্লাউডবার্স্টের প্রকোপ বাড়িয়ে তুলেছে।

মেঘভাঙা বৃষ্টি বা ক্লাউডবার্স্ট সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি ঘটে। এক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রচণ্ড গতিতে প্রবল বৃষ্টিপাতের ঘটনাই মূলত মেঘভাঙা বৃষ্টি। এর পেছনে বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার জটিল মিথষ্ক্রিয়া দায়ী। আর্দ্র বাতাস পাহাড়ি অঞ্চলে উপরে উঠে ঠান্ডা হয়ে জমাট মেঘ তৈরি করে। পরে এ মেঘ ভারী হয়ে ফেটে গেলে অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব অল্প সময়ে ৩০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের ঘটনাকে ক্লাউডবার্স্ট বলে। যা সাধারণ বৃষ্টি থেকে অনেক বেশি ঘনীভূত ও দ্রুত হয়। এটি মূলত আকস্মিক বৃষ্টিপাত।

হংকং সিটি ইউনিভার্সিটি এমিরিটাস অধ্যাপক জনি চ্যান বলেন, ‘এটি মূলত একটি বজ্রঝড়। যখন বজ্রঝড়ের মধ্যে প্রচুর পানি আসে, তখন এটি তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে নীচে নেমে আসে। তাই এটি অনেকটা বিস্ফোরণের মতো ঘটে। এজন্য এটিকে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি বলে। মূলত এর অর্থ হলো তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে এ ভারী বৃষ্টি নেমে আসে।’

যখন মেঘে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা জমে, তখন এটি অল্প সময়েই ভারী বৃষ্টির সৃষ্টি করে। যা চলে প্রায় ১০ থেকে ২০ মিনিট। পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বাতাস ওপরের দিকে উঠার প্রক্রিয়াকে বলে অরোগ্রাফিক ফোর্সিং। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপে বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী গতি আরও তীব্র হয়। এতে দ্রুতবেগে ভারী হয় মেঘ।

হংকং সিটি ইউনিভার্সিটি এমিরিটাস অধ্যাপক জনি চ্যান বলেন, ‘বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতি বাড়ছে। এতে ক্লাউডবর্স্টের মতো ঘটনাও বাড়ছে। মেঘ ঘনীভূত হওয়ার জন্য যে পরিমাণ দূষণকারী অবদান রাখছে, গুলো বেশিরভাগই হচ্ছে নগরায়নের ফলে। যার কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে।’

এর প্রভাবে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গোটা অঞ্চল। এর রেশ টের পাওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় ধ্বংসলীলা। হড়কা বানের সঙ্গে আশঙ্কা বাড়ে ভূমিধ্বসের। সম্প্রতি মেঘভাঙা বৃষ্টির ঘটনা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কয়েক দিনের ব্যবধানে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ভারতের উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরের পর পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে দেখা দিয়েছে এ বিপর্যয়। এছাড়া মেঘভাঙা বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়াও খুব চ্যালেঞ্জিং বিষয়

এ আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, দুর্বল উন্নয়ন প্রকল্প ও ব্যাপক বন উজাড় মূলত ভারতের হিমালয় অঞ্চলকে পরিবেশগতভাবে বিপজ্জনক করে তুলেছে। এতে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে ঘটনা বাড়ছে বলে জানান এ পরিবেশ বিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন:

পরিবেশ বিজ্ঞানী রবি চোপড়া বলেন, ‘পাহাড়ি বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প করতে হলে, ভূতত্ত্বের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে হবে। বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণ ও পর্যটনের ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে নগরায়ন হয়েছে ব্যাপকভাবে। এখন পাহাড়গুলোর মধ্যে দিয়ে রেলপথও তৈরি করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে না।’

মেঘভাঙা বৃষ্টিতে হুমকিতে পড়েছে পাহাড়ের জনজীবন। বিশ্বব্যাপী ১১০ কোটির বেশি মানুষ পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে। যারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তাৎক্ষণিক প্রভাবের মুখে আছে। পাহাড় ও গাছ কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করায় বেড়েছে ভূমিধসের ঘটনা।

স্থানীয়রা জানান, পাহাড় গাছপালার পরিমাণ দিন দিন কমছে। ঝর্ণাগুলোও মৃতপ্রায়। পাহাড়ি অঞ্চলে জলাবদ্ধতাও এখন নিয়মিত ঘটনা। বর্তমানে পাহাড়ের পাদদেশে বানানো হচ্ছে বড় বড় বাড়ি। ফলে দুর্যোগ বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও।

ভারতের হিমালয়ে ১০ হাজারের মতো হিমবাহ রয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে এগুলো দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তুষারপাত নির্ভর অঞ্চলগুলোতে তীব্র খরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ভূমিধ্বস, আকস্মিক বন্যা এবং ক্লাউডবার্স্টের তীব্রতাও বাড়ছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে অর্ধশত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তিন ভাগের এক অংশ হিমবাহের কারণে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

এফএস