এআই ভিডিও নিয়ে ‍যত বিভ্রান্তি: সতর্ক থাকার কৌশল

এআই প্রতীকী ফটো
তথ্য-প্রযুক্তি
0

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্ক্রল করতে করতে যে ভিডিওগুলো সামনে আসে, তার সবই যে বাস্তব—এমন ভরসা করার দিন শেষ। এখন এমন সব মুহূর্ত দেখা যায়, যা চোখকে চমকে দেয়, কিন্তু সত্যকে নয়। কারণ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বা এআই-জেনারেটেড ভিডিও এতটাই নিখুঁত হয়ে উঠেছে যে আসল-নকল আলাদা করাই এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। টিকটক, রিলস কিংবা ইউটিউব শর্টসে অসংখ্য ভিডিও এখন বাস্তবতার মুখোশ পরে আমাদের ফিডে জায়গা করে নিচ্ছে। তবুও সূক্ষ্ম কিছু ইঙ্গিত রয়ে যায়—যা ধরতে পারলে বোঝা যায়, পর্দার আড়ালে প্রযুক্তির কৌশলই কাজ করেছে; মানুষের ক্যামেরা নয়।

কীভাবে বুঝবেন কোনো ভিডিও এআই দিয়ে বানানো কিনা?

ডিপফেক ও এআই-জেনারেটেড কনটেন্টের দাপটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য-মিথ্যা আলাদা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য পর্যবেক্ষণ একটি ভিডিও আসল নাকি কৃত্রিম—তা বুঝে নিতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও প্রযুক্তিবিদদের মতামত মিলিয়ে এআই ভিডিও চিহ্নিত করার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ তুলে ধরা হলো।

ভিডিওর ফ্রেম দেখুন

এআই তৈরি ভিডিওর বড় একটি বৈশিষ্ট্য হলো নির্দিষ্ট ধাঁচের সেটিং। ভিডিওগুলোতে সাধারণত রাতের দৃশ্য, অতিরিক্ত অন্ধকার টোন অথবা ‘নাইট ভিশন’-ধরনের ফিল্টার দেখা যায়। এ ধরনের কালো বা অনিক্স রঙের আবহ তৈরি করা হয় মূলত যাতে ছোটখাটো গ্লিচ, ফ্রেমের অসঙ্গতি বা চরিত্রের অপ্রাকৃত নড়াচড়া চোখে না পড়ে।

এআই প্রতীকী ফটো |ছবি: সংগৃহীত

ভিডিওর ফ্রেমে ব্যবহৃত ডিভাইসে লোগো দেখা

ভিডিওর উৎস নিয়ে দাবি করা হলে সেটি খুঁটিয়ে দেখা জরুরি। ডোরবেল ক্যামেরা বা সিসিটিভিতে ধারণ করা ভিডিও হলে সাধারণত টাইমস্ট্যাম্প, লোগো কিংবা ইন্টারফেস ওভারলে থাকার কথা। এগুলো না থাকলে সন্দেহের কারণ থাকে, আবার থাকলেও সেগুলো যে সত্যিই আসল—তা নিশ্চিত নয়, কারণ এ ধরনের উপাদান এখন সহজেই এআই দিয়ে যোগ করা যায়।

বাস্তবতার সঙ্গে মিল না থাকা

বাস্তবতার সঙ্গে মিল না থাকা মুভমেন্টও বড় ক্লু। কোনো প্রাণী টানা একই গতিতে কয়েক সেকেন্ড লাফাতে থাকা কিংবা তিমি হঠাৎ জাহাজের ডেক থেকে কর্মীকে টেনে নেয়ার মতো দৃশ্য বাস্তবে অসম্ভব। এ ধরনের আচরণ বা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম ভঙ্গ করা যে কোনো দৃশ্যই সিনথেটিক ভিডিও হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।

ভিডিওর ডিউরেশন কম থাকা

ছোট দৈর্ঘ্যের ভিডিও এআই উৎপাদনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। বেশিরভাগ ভাইরাল এআই ভিডিও ৮ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যদি ভিডিও মাত্র ১০ সেকেন্ডের হয়, সন্দেহ করা উচিত—এতে কিছু লুকানো হয়েছে। অনেক সময় দীর্ঘ ভিডিও ছোট ছোট ক্লিপ জোড়া দিয়ে বানানো হয়, যা এআই জেনারেটরের সীমাবদ্ধতারই ইঙ্গিত।

এআই প্রতীকী ফটো |ছবি: সংগৃহীত

ভিডিও অডিওতে অসঙ্গতি

অডিওতেও থাকে বড় অসঙ্গতি। অনেক এআই ভিডিওতে শব্দ অত্যন্ত পরিষ্কার, আবার কোনো কোনো সময় সম্পূর্ণ নীরব থাকে। বাস্তব পরিবেশে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ থাকে—সেটি অনুপস্থিত হলে সন্দেহ তৈরি হয়। এমআইটি গবেষকদের মতে, এআই প্রায়ই শব্দ বিকৃত করে বা এমন কিছু যোগ করে যা খণ্ডন করা কঠিন।

লেখা বা টেক্সটে ভুল থাকা

লেখা বা টেক্সট-ভিত্তিক উপাদানে নজর দিলেও সত্য-মিথ্যা বোঝা সহজ। সাইনবোর্ড, গাড়ির নাম্বারপ্লেট, পোশাকের নকশা—এসব জায়গায় বিকৃত বা অসংগত লেখা এআইয়ের সীমাবদ্ধতার অন্যতম প্রমাণ।

অস্বাভাবিক মুভমেন্ট

একইভাবে মানুষ বা প্রাণীর শরীরের নড়াচড়া এআই ভিডিওতে প্রায়ই অস্বাভাবিকভাবে মসৃণ বা অসম্ভব হয়ে যায়। চোখের পলক কম হওয়া, ঠোঁটের চলাফেরা অডিওর সঙ্গে না মেলা, পটভূমির বস্তু বিকৃত হওয়া, হাতে থাকা জিনিস ঝাপসা হয়ে যাওয়া—এসবই কৃত্রিমতার লক্ষণ।

ভিডিওর ওয়াটারমার্ক দেখা

কিছু এআই জেনারেটর সোরা বা ভিও থ্রি ভিডিওতে স্বয়ংক্রিয় ওয়াটারমার্ক বা মেটাডেটা যুক্ত করে। এগুলো দৃশ্যমান থাকলে শনাক্ত করা সহজ হয়, যদিও ভাইরাল করার আগে অনেকেই এসব অংশ ক্রপ করে বাদ দেন। গুগল ডিপমাইন্ডের সিন্থআইডি প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে আরও নির্ভরযোগ্য শনাক্তকরণ সুবিধা দিচ্ছে।

পোস্টকারীর অ্যাকাউন্টের ইতিহাস খুঁজে দেখা

ভিডিও পোস্টকারী অ্যাকাউন্টের ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক এআই কনটেন্ট ফার্ম অল্প সময়ে ডজনখানেক অদ্ভুত ভিডিও পোস্ট করে। এমন হলে ধরে নেওয়া যায়, ভিডিওগুলোও এআই-নির্ভর।

এআই প্রতীকী ফটো |ছবি: সংগৃহীত

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এআই-তৈরি ভিডিও যতই উন্নত হোক, নিয়মিত ফ্যাক্টচেক এবং সোর্স যাচাই করলে ভুল তথ্য বা ভুয়া ভিজ্যুয়াল এড়ানো সম্ভব।

কে ভিডিওটি প্রকাশ করেছে—তা খতিয়ে দেখুন
ভিডিও আপলোডকারী ব্যক্তি বা পেজ কতটা নির্ভরযোগ্য, আগে কী ধরনের কনটেন্ট শেয়ার করেছে—এসবই প্রথম ক্লু। সন্দেহজনক বা অচেনা অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত ভিডিও সহজেই ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এটি কি পরিচিত বা বিশ্বাসযোগ্য কোনো মাধ্যম শেয়ার করেছে?
প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম, নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক বা যাচাই-যোগ্য সংগঠন যদি ভিডিওটি শেয়ার না করে, তাহলে তথ্যটি আরও সাবধানে যাচাই করা উচিত। বিশ্বাসযোগ্য সোর্স না থাকলে ভিডিওটি সন্দেহজনক ধরা যায়।

ভিডিওর দাবি কি সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে?
ভিডিওতে যা বলা হয়েছে বা দেখানো হয়েছে—তা কি কোনো মিডিয়া রিপোর্টে নিশ্চিত করা হয়েছে? বিশ্বস্ত নিউজ পোর্টাল বা সরকারি সূত্র যদি ওই ঘটনার উল্লেখ না করে, তবে ভিডিওর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

প্রয়োজন হলে এআই ভিডিও যাচাই টুল ব্যবহার করুন
অনলাইনে এখন বেশ কয়েকটি এআই ভিডিও ডিটেকশন টুল আছে, যেগুলোর মাধ্যমে ভিডিওর ফ্রেম, অডিও, মুভমেন্ট ও এনকোডিং বিশ্লেষণ করে কৃত্রিমতার উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়। সন্দেহ হলে এসব টুল দিয়ে আলাদা করে চেক করতে পারেন।

ভিও থ্রি এআই প্রতীকী ফটো |ছবি: সংগৃহীত

তবে দিন যত যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বা এআই-জেনারেটেড ভিডিও নিখুঁত হয়ে উঠায় আসল-নকল আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

কেন এআই ভিডিও শনাক্ত করা কঠিন হচ্ছে?

  • এআই এখন অত্যন্ত বাস্তবধর্মী ভিডিও তৈরি করতে সক্ষম।
  • টিকটক, রিলস ও শর্টসে এসব ভিডিও আসল ভিডিওর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
  • আগে যেসব ত্রুটি চোখে পড়ত, এখন সেগুলো অনেকটাই শোধরানো সম্ভব।

এআই জেনারেটেড ভিডিওর সাধারণ বৈশিষ্ট্য

  • মুখ, আঙুল বা শরীরের অংশে অসম্ভব মসৃণ বা অস্বাভাবিক টেক্সচার।
  • হঠাৎ ছন্দপতন বা দৃশ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন।
  • লিপ-সিংক সামান্য এলোমেলো হওয়া।

 ডিপফেক ভিডিও কীভাবে তৈরি হয়?

  • উন্নত এআই মডেল মানুষের মুখ, কণ্ঠস্বর ও অঙ্গভঙ্গি নিখুঁতভাবে নকল করে।
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাস্তব দৃশ্যের মতো ভিডিও রেন্ডার করতে পারে।

সেজু