২৫ বছর বয়সী তরুণের বুক চিরে খুবলে বের করে নেয়ার পর, অনাদরে-অবহেলায় হৃৎপিণ্ডটা ফেলে রাখা হয়েছিল দেহের উপরেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গেলো মার্চ মাসে সিরিয়ায় আলাউইত অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চলে মাত্র তিনদিনে নারকীয় কায়দায় এমন প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করে সুন্নি যোদ্ধারা। আর এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া সুন্নি যোদ্ধারা নির্দেশনা পেয়েছিল রাজধানী দামেস্কে ক্ষমতাসীন নতুন শাসকগোষ্ঠীর উচ্চ পর্যায় থেকে।
বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানে গেল ডিসেম্বরে দেশটিতে প্রায় ৫৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আসাদ পরিবারের পতন হয়। জানা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদপন্থী আলাউইতদের পাল্টা বিদ্রোহ ঠেকাতে চালানো হয় এই হত্যাযজ্ঞ। ৪০টি আলাদা এলাকায় চলে লুটপাট-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ।
সিরিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু আলাউইতরা। সত্তরের দশকের শুরুতে বিমান বাহিনীর জেনারেল হাফিজ আল-আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলে তার নেতৃত্বেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আলাউইত জনগোষ্ঠী। সাড়ে পাঁচ দশক ধরে আসাদ পরিবার ক্ষমতায় থাকায় দিন দিন বেড়েই চলে প্রতিপত্তি। হাফিজের ছেলে, ২০০০ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা বাশার আকস্মিক অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকেই বেকায়দায় আলাউইতরা।
২০০ বেশি প্রত্যক্ষদর্শী ও হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া আলাউইত সদস্য জানান, গেল ৭ মার্চ থেকে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বানিয়াস ও জাবলেহ শহর, আল-রুসাফা গ্রামে আসতে থাকা সুন্নি যোদ্ধারা প্রথম যে প্রশ্নটি বাসিন্দাদের করছিল, সেটি হলো সুন্নি নাকি আলাউইত।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘এখনও রাস্তাঘাটে অনেক মরদেহ পড়ে আছে। সেগুলো সরানো হয়নি। কুকুর-বিড়াল ছিঁড়ে খাচ্ছে মানুষের শরীর। নিজের চোখে দেখছি। কিন্তু কিছু করার নেই। লাশগুলো কবর দিতে চায় যারা, তাদেরও গুলি করে ওরা।’
আরেকজন বলেন, ‘আমার ছেলেকে তোলার চেষ্টা করছিলাম। ওরম মগজ বের হয়ে আমার হাতে চলে আসে। পুরো হাত রক্তে ভরে গিয়েছিল আমার। তারপর দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে চিৎকার শুরু করি।’
এসব হামলার পর থেকে লাতাকিয়া, তার্তুজ আর হামা প্রদেশে গ্রামের পর গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন আলাউইতরা। মৃত্যু ভয়ে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন রুশ সামরিক ঘাঁটির কাছে।
আসাদ সমর্থকদের বিদ্রোহে উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারানো ঠেকাতে গেল ৬ মার্চ নির্দেশনা জারি করে সাবেক বিদ্রোহী নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার।
সেদিনও সূর্যাস্তের মধ্যে লাতাকিয়া আর তার্তুজের চৌকিগুলোতে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় শতাধিক নিরাপত্তা সদস্যকে। অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে আহমেদ আল-শারার নতুন সরকারে যোগ দেয়া সুন্নি মিলিশিয়া গোষ্ঠী সুলতান সুলেমান শাহ ব্রিগেড ও প্রাদেশিক সরকার।
সিরিয়ার সুলতান সুলেমান শাহ ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ আল-জসিম বলেন, ‘আমরা শিশুকে আঘাত করবো, নারীদের ওপর চড়াও হবো, এটা অসম্ভব। আমাদের নীতিবোধ, আমাদের বিপ্লবে এসব অসম্ভব।’
সিরিয়ার তার্তুজ প্রদেশের গভর্নর আহমেদ আল-শামি বলেন, ‘আলাউইত সম্প্রদায় কালো, লাল, সবুজ- কোনো তালিকাভুক্তই নয়। তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়নি, প্রতিহিংসার লক্ষ্যও তারা নয়। সিরিয়ার অন্য সব সাধারণ মানুষের মতোই আলাউইতরাও অন্যায়ের শিকার। তাদের জোর করে সেনাবাহিনীতে পাঠানো হতো। তাদেরও রক্ত ঝরেছে। এখন তাদের নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দরকার।’
আলাউইত গণহত্যায় সরকারি বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দেয়নি দামেস্ক। তবে হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার তার লক্ষ্যের প্রতি হুমকি হিসেবে এই সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছিলেন নতুন রাষ্ট্রপ্রধান। জড়িতদের বিচারের আওতায় নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছিলেন।