‘গাজায় মানবিক শহর নির্মাণের আড়ালে রয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’

সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট ও ধ্বংসস্তূপে ফিলিস্তিনি শিশু
বিদেশে এখন
0

গাজায় 'মানবিক শহর' নির্মাণের আড়ালে রয়েছে 'কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প' গড়ে তোলার পরিকল্পনা, বললেন সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট। জানান, ইহুদি হলোকাস্টের মতোই ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন প্রচেষ্টার অংশ এসব ক্যাম্প। এদিকে, যুদ্ধবাজ দেশটির চতুর সব শর্তে থমকে আছে অস্ত্রবিরতির আলোচনা। এর মধ্যেই একদিনে গাজায় আরও ৭৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলো দখলদার বাহিনী।

'কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প' শব্দ দু'টো শুনলেই ভেসে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর হাজারো রাজনৈতিক বন্দিশিবির, যেখানে নারী-শিশু থেকে শুরু করে সাত লাখের বেশি ইহুদি ধর্মাবলম্বীকে নির্বিচারে বন্দি রেখে চালানো হয় এতোটাই অমানবিক নির্যাতন, যা বোঝাতে কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়। গ্যাস চেম্বারসহ সীমাহীন বর্বর নানা কায়দায় হাজারে হাজারে মানুষকে হত্যা করা হয় এসব ক্যাম্পে।

আট দশক পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। পার্থক্য শুধু, চল্লিশের দশকে নিপীড়িত গোষ্ঠীটিই একবিংশ শতকে হয়ে উঠেছে নিপীড়ক। পৌনে দুই বছরের আগ্রাসনে প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনিকে নির্বিচারে হত্যার পর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার রাফায় যে 'মানবিক শহর' গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, আদতে সেটি হবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, মন্তব্য সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্টের।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে টানা বিমান হামলায় মাটিতে মিশে গেছে রাফাহসহ প্রায় পুরো গাজা। রাফার ধ্বংসাবশেষে 'মানবিক শহর' গড়ে তুলতে এরই মধ্যে সেনাবাহিনীকে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কার্টজ। বলা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা হলেও ধাপে ধাপে পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে। গাজায় বর্তমানে বাস প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ওলমার্ট বলেন, ঠিক ইহুদি হলোকাস্টের মতোই ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন প্রচেষ্টার অংশ রাফার 'মানবিক শহর'। সত্যিকার ফিলিস্তিনি নিধন এখনও শুরুই হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

কারণ হিসেবে বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের চাপে বেসামরিক মানুষের সুরক্ষার কথা ভেবে এখনও হামলার আগে তাদের জানিয়ে এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দিচ্ছে সেনাবাহিনী; এবং সামরিক অভিযান শেষে ফিলিস্তিনিরা এলাকায় ফেরার সুযোগও পাচ্ছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হলে সকল সুযোগ হারাবে ফিলিস্তিনিরা।

ওলমার্ট বলেন, গাজার অর্ধেকের বেশি অংশ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে যখন সেখানে একটা ক্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা হয়, তখন এটা স্পষ্ট যে এটা গাজাবাসীর সুরক্ষার জন্য নয়, তাদের বাস্তুচ্যুত করার, কোণঠাসা করার এবং ছুঁড়ে ফেলার পাঁয়তারা মাত্র।

গার্ডিয়ানে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারেও নিজ বক্তব্যে অনড় ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসরাইল সরকারের নেতৃত্ব দেয়া ওলমার্ট বলেন, ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মাত্রা ক্ষমার অযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য।

ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট বলেন, ‘এই শব্দগুলো ব্যবহার করলেই বিশ্ববাসী বুঝবে যে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে এসব ক্যাম্পে। যখন এসব ঘটতে শুরু করবে, তখন এই 'মানবিক শহর' আসলে কী, সেসব বোঝার জন্য বা ব্যাখ্যার জন্য আমাকে দরকার হবে না। যারা এসবের নেপথ্যে, তারাই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করার কথা বলে। তারাই মনে করে যে ফিলিস্তিনি মানেই হামাস, আর কোনো ফিলিস্তিনির বাঁচার অধিকার নেই।’

গাজায় 'মানবিক শহর'-এর পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। যদিও এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের নীলনকশা বলে অভিযোগ ইসরাইলি মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী আর শিক্ষাবিদদের। যদিও নেতানিয়াহু প্রশাসনের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলেও মত বিরোধীদের।

ইসরাইলের সাবেক আইনমন্ত্রী ইয়েঅসি বেইলিন বলেন, ‘বিরোধী দলের প্রধান ইয়ার লাপিদ পার্লামেন্টে এ বিষয়ে যেটি বলেছেন, সেটি অনেকটাই সঠিক। তিনি বলেছেন যে এটা পাগলের প্রলাপ এবং সত্যিই এটা পাগলের প্রলাপ এবং আমি বলছি যে এটা ঘটবে না। কারণ এটা পাগলামি। এটা অনেক অনেক ব্যয়বহুল। শত-কোটি ডলারের বিষয়। এতে অনেক সময় লাগবে। এক থেকে দেড় বছর সময় লেগে যাবে এটি নির্মাণে। এতো সময় কার আছে? আমার মনে হয় যে কেউ নেতানিয়াহুর কানে দিয়েছে যে এরকমও সম্ভব, ঈশ্বর জানেন সে কে। সেনাবাহিনীও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে যে তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়।’

এদিকে, হত্যাযজ্ঞের ৬৪৭তম দিনে গাজায় আরও ৭৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী। আজ (মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই) ভোরেও বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের তাঁবুতে হামলা চালিয়ে হত্যা করে শিশুসহ কয়েকজনকে। খান ইউনিসে কবরে আগুন দেয়া এবং মরদেহ চুরির অভিযোগ উঠেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

এদিকে, যুদ্ধবাজ ইসরাইলের চতুর সব শর্তে থমকে আছে অস্ত্রবিরতির আলোচনা। অন্যদিকে, অস্ত্রবিরতি যথেষ্ট নয় বলে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।

সেজু