নবীনগরের জালশুকার মোল্লাবাড়ি: শত বছরের কাচারি বাংলোর গল্প

ব্রাহ্মণবাড়িয়া
হিরন্ময় জালশুকা মোল্লাবাড়ি
ফিচার
0

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার জালশুকা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মোল্লাবাড়ি এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী। শহরের খুব কাছে হলেও, এ গ্রাম যেন তার নিজস্ব শান্ত আর ছায়াঘেরা পরিবেশে আজও স্বকীয়তা ধরে রেখেছে। গ্রামটির এ মোল্লাবাড়িতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে শত বছরের পুরনো একটি কাচারি বা বাংলো ঘর, যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একসময় এ কাচারি ঘরেই ছিল এলাকার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ‘ডাকঘর’। চিঠি আদান-প্রদান আর ডাকপিয়নের ছোটাছুটিতে মুখরিত ছিল এ আঙিনা। তবে ই-মেইলের যুগে সেই কোলাহল এখন স্তব্ধ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় জীর্ণ হলেও, এ ডাকঘর আজও তার ঐতিহ্যের চিহ্ন ধারণ করে আছে। এ বাড়ির ভেতরে থাকা ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে নির্মিত একাধিক পাকা দালান আর তাতে থাকা আসবাবপত্রে আভিজাত্যের ছাপ আজও স্পষ্ট। বাড়ির উঠানে গেলে পাথরে খোদাই করা একটি বায়োগ্রাফি চোখে পড়ে, যা এ বাড়ির গৌরবময় ইতিহাসকে নতুন করে তুলে ধরেছে।

পুরনো ডাকঘর |ছবি: এখন টিভি

হিরন্ময় জালশুকা মোল্লাবাড়ি

এ বাড়ির একটি বিশেষ আকর্ষণ হলো হিরন্ময় জালশুকা মোল্লাবাড়ি শিরোনামে পাথরে খোদাই করা জীবনী। এখানে তুলে ধরা হয়েছে এ বাড়ির তিন কৃতিপুরুষের কর্মজীবন ও সাফল্যের গল্প: আনসার আলী মোক্তার, তার ছেলে আবদুর রউফ এবং আবদুর রউফের দুই ছেলে আবদুর রহিম ও আবদুর রহমান। তাদের হাত ধরেই এ বাড়িটি শুধু একটি বসতভিটা নয়, বরং একটি ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

নামফলক |ছবি: সংগৃহীত

আবদুর রউফ

ডাকনাম নওয়াব মিয়া। ১৯০৮ সালে জন্ম নেয়া এ কৃতিসন্তান কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন ইউনিভার্সিটি থেকেও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে ওরেগনের গভর্নর তাকে ‘ওরেগন অ্যাম্বাসেডর টু পাকিস্তান’ হিসেবে বিরল সম্মাননা দেন। অবসরের পর নিজ গ্রামে ফিরে এসে তিনি ১৯৩৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন। দুর্গম গ্রামে যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৫৬ সালে নিজ বাড়িতে ডাকঘর চালু করেন। তার অন্য দুই ভাই শামসুল হুদা (লাল মিয়া মুন্সি) ছিলেন দীর্ঘ ৩৫ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং আব্দুল হাই (জিল্লু মিয়া) ছিলেন পুলিশের ডিএসপি।

আবদুর রহিম

আবদুর রউফের জ্যেষ্ঠ ছেলে আবদুর রহিম হুমায়ুন চেয়ারম্যান নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি সাদেকপুর পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য তিনি মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তার অবদান ছিল অসামান্য। পরবর্তীকালে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দৈনিক আজাদ, দৈনিক কিষান ও দৈনিক বাংলার মুখের মতো পত্রিকায় কাজ করেন।

আবদুর রহমান

আবদুর রউফের তৃতীয় সন্তান আবদুর রহমান ওরফে আবু মিয়া ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন তিনি পাবলিক রিলেশন এবং ফ্যামিলি প্ল্যানিং কমিউনিকেশন বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ধরে রাখতে মোল্লাবাড়িতে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি আধুনিক পাঠাগার ‘আবদুর রহিম স্মৃতি পাঠাগার’। ২০১২ সালে সরকারের নিবন্ধন পায় পাঠাগারটি। পাঠাগারের নিচতলাজুড়ে বই রাখার সেলফ নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। এখানে যেমন থাকবে জ্ঞানের ভাণ্ডার, তেমনি ঐতিহ্য রক্ষায় এক পাশে থাকবে ডাকঘরের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা। এছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাঠকদের জন্য দ্বিতীয় তলায় থাকবে আবাসন সুবিধা।

বাড়ির বর্তমান অবস্থা |ছবি: এখন টিভি

মোল্লাবাড়ির এ সমৃদ্ধ ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে একটি ভালো বার্তা পৌঁছে দেবে বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান, যিনি নিজেও এ পরিবারের একজন সদস্য।

ইএ