জুলাই গণঅভ্যুত্থান: আন্দোলনে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় উত্তরা

জুলাই আন্দোলনে উত্তরায় ছাত্র-জনতা
বিশেষ প্রতিবেদন
0

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম হটস্পট উত্তরা। ১৮ জুলাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিমানবন্দর মহাসড়ক। শতাধিক শহীদ উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করতে বুক পেতে দিয়েছিলো স্বৈরাচারের বুলেটের সামনে। কারফিউ ভেঙে, জুলুমশাহীর মসনদকে ধুলোয় মিলিয়ে দেবার প্রথম ও চূড়ান্ত মিছিলের সূত্রপাতও উত্তরা থেকেই। অথচ এখানে নেতৃত্ব দেয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাই বলছেন, তারা নানাভাবে উপেক্ষিত।

শেষ মরণকামড়ের জন্য যখন পূর্ণশক্তি নিয়ে প্রস্তুত নিষ্ঠুর স্বৈরাচারের সকল আয়োজন। তখন সবার আগে কারফিউয়ের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে উত্তরার সংগ্রামী মুক্তিকামী জনতা, যে দেয়ালের দৃষ্টিসীমার দূরত্বেই ছিলো আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির তোরণ।

আন্দোলনকারীরা বলেন, ‘বাসা থেকে বের হয়েছিলাম এটা ভেবেই যে হয়তো আর বাসায় না ও ফিরতে পারি। হয়তো শহিদ হয়ে যেতে পারি। আমরা শুধু দোয়া করছিলাম যাতে কোন মিরাকল হয়।’

এরপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত খবর, পালিয়েছে শেখ হাসিনা। ছাত্র জনতার দখলে যখন গণভবন। তখনও উত্তাল উত্তরা। বিজয় উদযাপনরতদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। তারই একটি গুলি লাগে ছয় বছর বয়সী জাবির ইবরাহিমের পায়ে।

কবির হোসেনের সন্তানকে কেন জীবন দিতে হলো চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে? একজন নার্সারি পড়ুয়া শিশুর সঙ্গে কোটা, বৈষম্য কিংবা রাজনীতির কি সম্পর্ক থাকতে পারে? বছর ঘুরলেও সে প্রশ্ন আজও তাড়া করে ফেরে বাবার হৃদয়ে।

কবির হোসেন বলেন, ‘যখন আমার ছেলে মারা গেলো তখন আমি বলছিলাম আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর জন্য সে শহিদ হয়েছে। কিন্তু এ দেশ যেভাবে তাকে হত্যা করেছে, হাসিনা যেভাবে এত বছর তার শাসন কায়েম করেছে এটা আমাদের আশা ছিলো না।’

আধিপত্যবাদের কালো থাবা থেকে মুক্ত হতে হটস্পট হয়ে উঠেছিলো উত্তরা। বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে এক কাতারে দাঁড়ায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সর্বস্তরের ছাত্র জনতা। মানুষের বুক বিদীর্ণ করা হিংস্র বুলেট, যন্ত্রদানব, রায়ট, এপিসি, ভয়ংকর সব মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে সেসময় জনতা মুখোমুখি হয় নিরস্ত্রভাবেই। যা দুমড়ে মুচড়ে দেয় স্বৈরাচারের মসনদ।

শুরুটা ১৬ জুলাই, ২০২৪। আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, উত্তরায় যেভাবে সংগঠিত হলো ছাত্র জনতা। লক্ষ্যই ছিলো দেশকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা।

নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সওয়াত মাহমুদ শাইখ বলেন, ‘আমরা আগের রাতে ম্যাপ নিয়ে বসতাম। তারপর ঠিক করা হতো আমরা কয়েকটা ভাগে বিভক্ত হতাম।’

অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী ফারহানা বুশরা অমি বলেন, ‘আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে মেইন দুইটা সড়ক দখল করি। যাতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় আর আমাদেরকে নজরে পড়ে সবার।’

একদিন বিরতি দিয়ে ১৮ জুলাই ফের মাঠে নামে ছাত্র জনতা। এদিন সকাল থেকেই রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। পুলিশ বাধা দিলে, শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। আন্দোলনকারীরাও ছুঁড়তে থাকেন ইট-পাটকেল।

এদিন দুই শতাধিক আহত হবার পাশাপাশি ২০ জনেরও বেশি শহীদ হন।

আন্দোলনকারীরা বলেন, ‘১৮ জুলাই পুলিশ আমাদের অবাক করে দিল। যখন আমরা মিছিল নিয়ে বিএনএসে আসা শুরু করলাম হঠাৎ করে পুলিশ তখন সাউন্ড গ্রেনেড মারলো। একটার পর একটা রিকশা শুধু কুয়েত মৈত্রীতে ঢুকেছে। এবং ওই লাশগুলোর অবস্থা মুমুর্ষ। কারো মাথায়, কারো বুকে লেগেছে এবং বুঝা যাচ্ছে এরা আর বাঁচবে না।’

এরপর ৫ আগস্ট পর্যন্ত অদম্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে উত্তরার জনতা। এমনকি ইন্টারনেট বন্ধের সময়গুলোতেও থেমে থাকেনি সংগ্রাম। বিনিময়ে শতাধিক শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় উত্তরা।

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘নেটওয়ার্ক যখন ছিলো না তখন আমরা বাটন ফোন ব্যবহার করতাম। ওইদিন আমাদের সামনে যে সারি ছিলো মনে হয় না তাদের একজনও বেঁচে আছেন।’

পুরো জুলাই আগস্টে, পতিত সরকারের বাধার মুখেও আন্দোলনকারীদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছে উত্তরার কুয়েত মৈত্রী ও উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক ও স্টাফ। যদিও আন্দোলনে আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিতে এসে মারা যাওয়া শহীদের সংখ্যাও গোপন করার অভিযোগ রয়েছে হাসপাতাল দুটির তৎকালীন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় মো. রায়হান হোসেন বলেন, ‘উনারা কোনো ডকুমেন্ট দেয়নি। কোন প্রেসক্রিপশন বা কোন কাগজ কিছুই দেয়নি কোনো আহত বা নিহতদের।’

উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক সভাপতি ডা. রোকনুজ্জামান রুবেল বলেন, ‘আমার এখানে সর্বপ্রথম ১৮ তারিখে ৩ জন ইনজুরি নিয়ে আসেন। এর মাঝে ২ জন মারা যান। সেই ডিক্লেরেশনও আমরা করতে পারিনি। আমাদের করতে দেয়া হয়নি।’

জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠকদের কাছে প্রশ্ন, বছর ঘুরলেও কতটা প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে তাদের? এক বছরে জুলাই ঘোষণাপত্র, বিচারের অগ্রগতি নিয়ে হতাশ অনেকেই।

তারা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এত মাস পেরিয়ে গেলো সেই প্রোক্লেমেশনটা আসলো না। কেন আসলো না, কার গাফিলতিতে আসলো না তা নিয়ে আমরা আশাহত। ঘোষণাপত্র টা একটা বিপ্লবের স্বীকৃতি হিসাবে দেয়া হয় মূলত। এখন পর্যন্ত আমরা সেটা পাইনি।’

ইএ