২০২৪ সালের জুলাই, শহরটা যেন কাঁপছিল। একটা রিকশা চেপে এলো মুগ্ধ, আরেকটা রিকশা নাফিসের মরদেহ নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছে। অসংখ্য রিকশায় বাংলাদেশের মানচিত্র সবুজ ছাপিয়ে লাল হতে শুরু করে জুলাইয়ে।
লাল রঙে যখন এই শহর ছেয়ে গেছে। তখনও হার মানেনি নির্ভীক যুবকরা। তাই তিন চাকার বিপ্লবী সুজনের উন্নত শীর স্যালুট দাগ কেটেছে গোটা বিশ্বের।
কোটার বিরুদ্ধে মেধার আন্দোলন রূপ নেয় সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে। গণহত্যায় যা আরও ফুসে ওঠে। অংশ নেন হকার, দিনমজুর, চা দোকানি থেকে শুরু করে সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষ।
নাফিসের মরদেহ নয়, নুরু মোহাম্মদ তার রিকশার নিয়েছিল যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।
নুরু মোহাম্মদ বলেন, ‘চেনের ভেতর হাত যাচ্ছে, পরে এখানে (রিকশার একটা জায়গা দেখিয়ে) হাত ঢুকিয়ে দিয়েছি। আল রাজি হাসাপাতাল পর্যন্ত আমি একা নিয়ে গিয়েছি, একটা পাখি পর্যন্ত আসেনি যে তাকে ধরবে। আমি নিজে ক্লান্ত, ওখান থেকে টেনে চক্ষু হাসপাতাল পর্যন্ত আমি একা নিয়ে গেছি। কেউ তো আসলো না।’
সম্মান আর ভালোবাসায় সুজনের বিপ্লবী সালাম যেন সাহসের বারুদ হয়ে দ্রোহের আগুন জ্বেলেছিল তরুণদের হৃদয়ে।
রিকশা চালক সুজন বলেন, ‘দেখতেছি শিশু বাচ্চারা মারা যাচ্ছে। আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে ছাত্র-জনতা থাকবে না। তো আমি একটা সম্মান জানাইলাম এভাবে যে, ক হাত আমাদের বান্ধা, আর এক হাত দিয়ে আমি স্যালুট।’
এখনও অনেক রিকশা চালকের গায়ে আছে রাবার বুলেটের চিহ্ন। স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন জুলাইয়ের।
রিকশা চালকদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ফ্লাইওভার থেকে নামার সমই গুলি করছে। আমার পিঠে, মাথায় লাগছে। আমি আবার ঢাকা মেডিকেলে আসছিলাম।’
এই আহত শহর অ্যাম্বুলেন্সহীন হয়ে পড়ে জুলাইয়ে। রিকশাই হয়ে উঠেছিল এম্বুলেন্স আর কত কাঁধ ভিজে ছিল রক্তে। সে স্মৃতি কেবল বন্ধুরা জানে।
জুলাই যোদ্ধা সায়াদ বিন সোহেল বলেন, ‘ফায়ারিংয়ের সময় আমাদের অনেক ঝাত্র-জনতা মাটিতে পড়ে গেছে। কেউ সাহস করেনি তাদের নেয়ার জন্য, এই মরদেহগুলো কেউ নিতে চায়নি। ওইসময়ে আমাদের এই রিকশাচালক ভাইরা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে।’
ছাত্রদের কাছে এক একটা রিকশা হয়েছিল ভরসার জায়গা। তারা শুধু চাকায় প্যাডেলই টানেননি, টেনেছেন সাহসের ভারও।
সায়াদ বিন সোহেল বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সের সংকট চলাকালে আমাদের লোকাল অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রিকশা চালক ভাইদের যানবাহনটা আমাদের ছিলো।’
জুলাই যোদ্ধা ফজলে রাব্বি বলেন, ‘যখন আন্দোলন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এবং উনাদের যখন অংশগ্রহণ পাই তখন আমরা যারা শিক্ষার্থী ছিলাম, আমরাই জিনিসটা নিশ্চিত হই যে, আন্দোলন ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পরিণত হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হচ্ছে।’
জুলাই যোদ্ধা ফাতিমা তাসনিম জুমা বলেন, ‘এই মানুষগুলোর অবদান এবং এই মানুষগুলো ছিলো বলেই আমরা দুই হাজার শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের আরেকটা পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি।’
আপসের শহরে যারা আপস করে না, তাদের নাম লিখা হয় ইতিহাসে। তবে উল্টো পথের যাত্রায় সেই সাহসীদের খোঁজ নেবার কেউ নেই।
এই রাজপথ আর উত্তাল না হোক। তরুণরা পাক স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ। এমনটাই চান এই তিন চাকার যোদ্ধারা।