একাত্তর থেকে চব্বিশ: যুদ্ধ-বিপ্লবের ইতিহাস নির্মাণে স্লোগান

জুলাই আন্দোলনে স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে শিক্ষার্থীরা
দেশে এখন
0

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ’৯০ এর গণআন্দোলন, সবশেষ ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থান। যুগে যুগে দেশের গণআন্দোলনকে উদ্বেলিত করেছিল দৃপ্ত স্লোগান। ইতিহাস বিনির্মাণে স্লোগান এক মোক্ষম অস্ত্র। ’২৪ এর আন্দোলনেও স্বতন্ত্র আর সৃষ্টিশীল স্লোগানের উচ্চারণ অন্যতম পুঁজি ছিল গণমানুষের।

’২৪-এর কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল ‘কোটা না মেধা, আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ সহ বিভিন্ন স্লোগান। তবে মোড় ঘুরিয়ে দেয় শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য। যে মন্তব্যে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।

২০২৪ এর ১৪ জুলাই, মধ্যরাত। ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ প্রতিবাদী স্লোগানে প্রকম্পিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় দাবানলের মতো।

সূর্যসেন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মূলত প্রথমে শুরু হয়েছিল সূর্যসেন হল থেকে। এরপর সেটা জিয়া হল, বিজয় একাত্তর হল এবং হলপাড়া থেকে শুরু করে সমগ্র ঢাবিতে ছড়িয়ে পড়ে। স্লোগানটা আসলে সবাইকে বাধ্য করেছিল ছাত্রলীগের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আন্দোলনে নেমে যেতে।’

ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এনামুল হাসান অনয় বলেন, ‘সারা বাংলা কারাগার, শেখ হাসিনা স্বৈরাচার, ছি ছি ছি হাসিনা, লজ্জায় বাঁচিনা এ স্লোগানগুলো ছিল একদম জনগণের ভেতরকার ভাষ্য।’

১৬ জুলাই ২০২৪, রংপুরে প্রতিবাদের আইকন হিসেবে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যান আবু সাঈদ। পুলিশের গুলিতে মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আন্দোলনে জোয়ার আসে। স্লোগান পায় নতুন রূপ। ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর, আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’এমন স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ।

২৫ জুলাইয়ের পর বদলে যেতে থাকে বয়ান। গণঅভ্যুত্থান এক সুতোয় যুক্ত করতে থাকে আপামর জনগণকে। গণদাবী উচ্চারিত হয় প্রতিবাদী স্লোগানের মাধ্যমে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘একটা স্লোগান আমাদের সবার মাথায় ছিলো হাসিনাকে কোনভাবে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না। কারণ সারা দেশে এ শব্দটার চাহিদা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে হাসিনাকে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে গোটা বাংলাদেশে এটা ছড়িয়ে যাবে। জনগণের মুখ দিয়ে উচ্চারিত করানো হাসিনার পদত্যাগ আমরা কিন্তু এভাবেই এক দফা এক দাবির বিষয়টি এস্টাবলিশ করে গিয়েছি।’

শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, ‘স্লোগানগুলোতে একটা এলিমেন্ট যুক্ত করার বিষয় ছিলো। যেমন যারা চাকরি প্রত্যাশী তাদের যে সরকার নানা ধরনের ট্যাগ দিচ্ছিলো সেগুলো ডিজমেন্টাল করার জন্য নানা ধরনের প্রক্রিয়া আনরা ব্যবহার করছিলাম। স্লোগানগুলো এমনভাবে সাজানো হতো যাতে স্লোগানের মধ্যে পুরো ন্যারেটিভটা চলে আসে।’

দিন গড়ায়, আন্দোলনের ভাষাও বদলায়। আপস না সংগ্রাম, দালালি না রাজপথ, এক দুই তিন চার, স্বৈরাচার গদি ছাড় স্লোগান তখন তুঙ্গে। মানুষের কণ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ে শহরের দেয়ালে দেয়ালে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন বলেন, ‘আমরা দেখলাম যে নতুন কিছু স্লোগান তৈরি হলো। এবং এ স্লোগানগুলো আসলে আন্দোলনটাকে শব্দিত করে তুলেছে।’

৩ আগস্ট, ২০২৪। শহীদ মিনার থেকে এক দফার দাবির ঘোষণায় আসে নতুন স্লোগান। ‘দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’

পরদিন লং মার্চ টু ঢাকা ঘোষণার বার্তা আসে। ‘ঢাকায় আসো জনতা, ছাড়তে হবে ক্ষমতা’ ধ্বনিতে উত্তাল সারাদেশ। এরপরই আসে ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট, স্বৈরাচারের পতন। উল্লসিত জনতার কণ্ঠে শোনা যায় শেখ হাসিনার পলায়নের স্লোগান।

ইএ