তাদের বিশ্বাস, এ ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ, গ্লানি, হতাশা, অমঙ্গল মুছে গিয়ে নতুন বছরে সুখ শান্তি কল্যাণ বয়ে আনে। পাহাড়ের প্রধান এ সামাজিক উৎসবকে ঘিরে নানান বর্ণে আর আয়োজনে সেজেছে পাহাড়ি জনপদ। উৎসবের এ আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।
আজ (শনিবার, ১২ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৬টায় রাঙামাটি রাজবন বিহারের পূর্ব ঘাটে উৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুল ভাসানো হয়েছে। এতে অংশ নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সাবেক এমপি ঊষাতন তালুকদার, উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, সদস্য সচিব ইন্টুমনি তালুকদার, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ পাহাড়ি নারী-পুরুষ।
এছাড়া সকাল আটটায় শহরের গর্জনতলী মধ্যম দ্বীপে রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ ত্রিপুরাদের ফুল নিবেদন উৎসব উদ্বোধন করেন। এরপরে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে ত্রিপুরা শিল্পীরা নিজেদের পোশাক ও অলংকারে সজ্জিত হয়ে বর্ণিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা তুলে ধরেন। এছাড়া তবলছড়ির কেরানী পাহাড় ঘাটেও ফুল ভাসানো হয়েছে ফুল।
মূলত চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলাবর্ষের বিদায় ও বরণ উপলক্ষে এ উৎসব উদযাপন করে পাহাড়ি জনগণ। চলে ২৯ চৈত্র থেকে পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত। নদীতে ফুল ভাসিয়ে শুরু হয় তিন দিনের উৎসব।
বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের অংশগ্রহণে এটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাইং আর চাকমারা উৎসবটিকে বিঝু নামে পালন করে। এ তিন নামের অদ্যাক্ষর নিয়েই ‘বৈসাবি’।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৪টি পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি। এর বাইরে তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, রাখাইনরা সাংক্রান ও অহমিয়ারা বিহু, সাঁওতালরা পাতা নামে তিন দিনের উৎসব পালন করে।
উৎসবে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে সবচেয়ে বেশি কদর থাকে পাজন (পাঁচন) ও তরমুজ পরিবেশন নিয়ে। কমপক্ষে ২১ পদের সবজি মিশিয়ে রান্না হয় সুস্বাদু পাজন তরকারিটির। এছাড়াও পরিবেশন করা হয় ঘরে তৈরি মদ, মিষ্টান্ন, পায়েস, পানীয়, ফল ও ভোজনসহ নানা খাবার। আবহমান বাংলার চিরাতি বৈশাখী উৎসবের অংশীদার হন পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও।
শনিবার সকালে রাঙামাটি শহরের কাপ্তাই হ্রদের তীরে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে সূচিত হয় উৎসবটির। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ফুলবিঝু, মারমারা পাইংছোয়াই, ত্রিপুরারা হারিবৈসুক নামে পালন করে। এদিন থেকে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে শুরু হয় আপ্যায়নের নানা আয়োজন। ঘরগুলো সাজানো হয় বিজু ফুল ও নিম পাতা দিয়ে।
পূর্ব রাজবাড়ি ঘাটে ফুল নিবেদন করতে আসা প্রিয়াঙ্কা চাকমা বলছিলেন- এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। গঙ্গা মায়ের কাছে ফুল নিবেদন করে আশীর্বাদ চেয়েছি।
মিনতি চাকমা বলেন- সন্তানদের পড়াশোনা ও নিজেদের সুখ সমৃদ্ধি কামনা করেছি গঙ্গা মায়ের কাছে। আশা করছি নতুন বছর আমাদের ভালো কাটবে। একই সাথে হিংসা বিদ্বেষ, হানাহানি দূর হয়ে দেশের ও বিশ্বের মানুষের মঙ্গল কামনা করেছি।
ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিদ্যুৎ শংকর ত্রিপুরা বলেন, ‘পুরনো বছরের দুঃখ, গ্লানি, হতাশা, অমঙ্গল মুছে গিয়ে নতুন বছরে সুখ সমৃদ্ধি, শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনবে। এই প্রার্থনা করে গঙ্গাদেবীর প্রতি ফুল নিবেদন করেছি।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব।সে মানুষ হিসেবে মানবিক গুণাবলী আমাদের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে আমরা একে অপরের মধ্যে আরও ভাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমাদের বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবো। এবং পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী একটা সমাধান হবে। এই পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা যাতে আর ঝুলে না থাকে। এই পবিত্র দিনে আমরা এই প্রার্থনা করে আমরা ফুল ভাসিয়েছি।’
রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষ পরম্পরায় এসব অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন। এটা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে বরণে বর্ণিল উৎসবে সামিল হয়েছেন পাহাড়ের মানুষ। নতুন বছরে সবার সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনা করছি।’
১৩ এপ্রিল উদযাপিত হবে উৎসবের মূল দিবস। এ দিন চাকমারা মূল বিঝু, মারমারা সাংগ্রাইং আক্যা, ত্রিপুরারা বৈসুকমা নামে পালন করে উৎসবটির। ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন বা উৎসবের তৃতীয় দিন চাকমারা গোজ্যেপোজ্যে, মারমারা সাংগ্রাইং ও ত্রিপুরারা বিসিকাতাল নামে পালন করবে।
বৈসাবির এদিনে একাট্টা হয় নব বর্ষবরণ বা বৈশাখী উৎসব। এরপর ১৫ এপ্রিল হতে সপ্তাহব্যাপী রাঙামাটিসহ তিন জেলার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হবে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাইং জলোৎসব। আর এর মধ্য দিয়েই পাহাড়ের এই বর্ণিল বর্ষবরণ উৎসব।