নগরকন্যার মন খারাপের দিনে প্রকৃতিজুড়ে মন যোগানোর হরেক রকমের আয়োজন। সবুজ চাদর গায়ে জড়ানো তনয়ার চোখজুড়ে যখন অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণ তখন তার মন ভালো করতেই একে একে হাজির সোনালু, কৃষ্ণচূড়া আর জারুল, বাদ পড়েনি কুরচি, সমুদ্রজবা কিংবা কনক চূড়ারাও।
‘এসো বসো আমার উঠোনে বুক ভরে নাও শ্বাস- শীতল পাটি বিছিয়ে দেব তাল পাতার বাতাস’ নগর কন্যার এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজির ফুলের দল। কন্যার মন ভালো করার সবচেয়ে বড় দায় যেন জারুলের। নববধুর কানের ঝুমকোর মতো ঝুলে থাকা জারুল যেন দুলছে নগরকন্যার বিবাহের বাতাসে।
এদিকে নগর কন্যার মন যোগানোর কৌশল নির্ধারণে যেন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছে কনকচূড়া ও সোনালু। আর বালিকার অভিমান ভাঙানোর এক দফা দাবিতে যেন ফুঁসে উঠছে রুপসী পালাম, সে মিছিল দেখে বসে থাকতে পারেনি সমুদ্রজবাও।
ফুলকুমারীর মান ভাঙ্গাতে তপ্ত দুপুরের এমন আয়োজনে খানিকটা শীতলতার আশ্বাস হলে মন্দ হয় না, সে ভাবনা থেকেই বুঝি নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হাজির রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়া। তবে সঙ্গে বৃষ্টি না এলেও এসেছে পুষ্পস্রোত। মহিনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ফুলেরা যেন গাইছে, পিচগলা রোদ্দুরে-বৃষ্টির বিশ্বাস- তোমায় দিলাম আজ।
একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘ফুলের দিক থেকে বলতে গেলে হচ্ছে কাঠগোলাপ, জারুল, সোনালু, বিশেষ করে জারুল ফুলটা আমাদের এত আকর্ষণ করে যে, এটার সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হয়ে যাই।’
একজন নারী বলেন, ‘আমাদের যে প্রকৃতিতে ফুল বা সবুজ গাছপালা আছে বা এই যে কাঠগোলাপ বা সোনালু, অন্যান্য যে ফুলগুলোও আছে সেগুলো আমরা শুধু কোনোরকম বের হয়ে ছবি তুলে, ঘরে বসে স্টোরি দিয়ে দেখালাম যে আমরা বের হয়েছি। কিন্তু আমরা জিনিসটা আসলে ঠিকমতো উপভোগ করতে পারলাম না।’
অথচ প্রকৃতির ঢেলে দেয় এ রূপের বিনিময়ে ক্রমশ বাড়ছে প্রকৃতি ধ্বংসের আয়োজন। মানবসৃষ্ট কারণে নষ্ট হচ্ছে বনভূমি, কমছে সবুজ। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য হলেও রংপুরে এর পরিমাণ কেবল ১২ শতাংশ। গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালেই রংপুরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে এক হাজার ১৯০ একর।
বেরোবি দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আব্দুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, ‘শহর এলাকায় যে গাড়িগুলো চলছে সেগুলো মূলত ফসিল ফুয়েল বার্ন করা হচ্ছে। তেল, গ্যাস বার্ন করে গাড়ি চালানোতে আমাদের গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণটা বেড়ে যাচ্ছে। মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যে একটা প্রভাব ফেলছে।’
এদিকে সবুজায়ন কমায় লাফিয়ে বাড়ছে গরমের মাত্রা। গত কয়েক বছরে রংপুরে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক সাত থেকে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি থাকার কথা থাকলেও তাপমাত্রার পারদ উঠছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। পরিবর্তন হচ্ছে পত্র পল্লব ও ফসলের ঋতুচক্র।
বেরোবি ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তাপমাত্রার যে অসমতা তৈরি হয়েছে তার ফলে অঞ্চলের বৃষ্টির প্যাটার্নটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটার প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। ঠিক একইভাবে প্রকৃতিতে অন্য সব উদ্ভিদের ওপরও কই প্রভাব পড়ছে।’
নাগরিক ও প্রকৃতির পরস্পরের ইশতেহারেই দীর্ঘ হবে এমন লাল সবুজে পুষ্পের বিচ্ছুরণ। বাসযোগ্য পৃথিবী ও সুনির্মল প্রকৃতির জন্য অনিবার্য কেবল একে অপরের ভালো রাখার সন্ধি।