কালিগঙ্গা নদীতে নৌকাবাইচ, দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়

মানিকগঞ্জ
কালিগঙ্গা নদীতে নৌকাবাইচ
এখন জনপদে
0

বর্ষার উচ্ছলতা আর গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সমন্বয়ে মানিকগঞ্জের বেউথা কালিগঙ্গা নদী যেন প্রাণ ফিরে পেল। আজ (শনিবার, ২৩ আগস্ট,) জেলা প্রশাসনের আয়োজনে নদীজুড়ে অনুষ্ঠিত হলো বর্ণাঢ্য নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। নদীর দুই তীরে হাজারো মানুষের ভিড়, মাঝিদের বৈঠার ছন্দ আর দর্শকদের করতালিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছিল এক প্রাণচঞ্চল উৎসবমুখর আবহে।

বাংলার গ্রামীণ জীবনে নৌকাবাইচ শুধু একটি খেলা নয়, এটি এক প্রাচীন ঐতিহ্য। বহু বছর ধরে নদীমাতৃক এ ভূখণ্ডে বর্ষা মৌসুম মানেই ছিল নৌকাবাইচের উৎসব। মাঝিদের ধ্বনি আর বৈঠার টানে নদী মুখরিত হতো, গ্রাম জেগে উঠত এক অনন্য আনন্দে। কিন্তু আধুনিকতার স্রোতে এ ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছিল।

এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় মানিকগঞ্জসহ আশপাশের ছয় জেলার নৌকা। ছিপা, খেল্লা, ছান্দি, গয়টা এমন নানা প্রকারের মোট ২৩টি বাহারি নৌকা সাজিয়ে আসে প্রতিযোগিতায়। প্রতিটি নৌকায় ৩০ থেকে ৫০ জন মাঝি বৈঠা চালিয়ে অংশ নেন। নদীর বুক জুড়ে ছুটে চলা নৌকা, দর্শকের করতালি আর ঢাকঢোলের তালে প্রতিটি মুহূর্ত রূপ নেয় উৎসবের আবহে।

মোল্লা বাড়ী নৌকার মাঝি হাশেম আলী বলেন, ‘বাইচ মানেই আমাদের প্রাণের খেলা। বৈঠা চালাতে কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু হাজারো মানুষের উচ্ছ্বাস আমাদের সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। এ সময়ে যেখানে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় সেখানেই আমরা অংশ নেই।’

প্রতিযোগিতার দিনে আকাশ ছিল মেঘলা, মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টিও হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি যেন মানুষের উৎসাহকে আটকাতে পারেনি। ভিজে ভিজে হাজারো দর্শনার্থী নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেন প্রতিযোগিতা। পরিবার পরিজন নিয়ে আসা অনেকেই জানান, এমন আয়োজন আগে দেখেননি তারা।

দর্শনার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম বৃষ্টিতে হয়তো মানুষ কম আসবে, কিন্তু এসে দেখি নদীর দুই পাড়ে যেন মেলা বসেছে। একটু পা ফেলার জায়গা নেই। তবে বৃষ্টিতে ভিজলেও আনন্দ পেয়েছি।’

আরেক দর্শক শিউলি আক্তার বলেন, ‘আমি সেই ছোট বেলায় এ বাইচ দেখেছি। আজ স্বামীকে নিয়ে বেউথা কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে এসেছি। এমন আয়োজন শুধু বিনোদন নয়, আমাদের সন্তানরা এখানে এসে আমাদের সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখতে পারে। তাই প্রতিবছর যেন হয়, সেই প্রত্যাশাই করছি।’

আরও পড়ুন:

এমন আয়োজন মানেই নদীপাড়ে মেলার আমেজ। নৌকাবাইচ দেখতে আসা মানুষের ঢলকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে অস্থায়ী দোকানপাট। ভেলপুরি, চানাচুর, আইসক্রিম থেকে শুরু করে খেলনা ও গ্রামীণ পিঠার দোকানে ভিড় লেগে থাকে সারাদিন।

ব্যবসায়ী হাসান আলী বলেন, ‘আজকের দিনটা আমাদের জন্য বড় সুযোগ। স্বাভাবিক দিনে যেখানে এক হাজার টাকার বেচাকেনা হয়, আজকে সেখানে চার-পাঁচ হাজার টাকার মাল বিক্রি করেছি। এ ধরনের আয়োজন শুধু বিনোদনের নয়, স্থানীয় অর্থনীতিকেও প্রাণবন্ত করে তোলে।’

চারটি বিভাগে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের জন্য ছিল আকর্ষণীয় পুরস্কার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন। আর চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন’স এর জন্য মোটরসাইকেল পুরস্কার দেওয়া হবে।

একজন বিজয়ী মাঝি বলেন, ‘আমরা তো গ্রামীণ মানুষ। এতো মানুষের সামনে নৌকা বাইচতে পারাটাই গর্বের বিষয়। পুরস্কার পেলে খুশি হবো, তবে সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো গ্রামের মানুষকে খুশি করা।’

নৌকাবাইচ শুধুমাত্র এক দিনের বিনোদন নয়, এটি ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রজন্মের সংযোগ তৈরি করে। আধুনিক জীবনযাত্রার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে নতুন করে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস হলো এ আয়োজন।

সাংস্কৃতিক কর্মী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন আয়োজন মানুষকে তাদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত করে। শহরের ছেলে মেয়েরাও আজ গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্বাদ পেলো। নৌকাবাইচ কেবল খেলা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির উৎসব।’

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ তাই নতুন করে ফিরিয়ে আনল সেই পুরোনো আমেজ।

জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘মানিকগঞ্জের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই আমরা এ আয়োজন করেছি। আগামীতে প্রতিবছরই নিয়মিতভাবে নৌকাবাইচ আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে।’

নৌকাবাইচ শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, এটি ছিল সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, আনন্দের উৎসব, আর অর্থনৈতিক গতিশীলতার দিন। হাজারো মানুষের উপস্থিতি, মাঝিদের প্রাণঢালা পরিশ্রম, ব্যবসায়ীদের জমজমাট বিক্রি সবকিছু মিলিয়ে দিনটি ছিল সত্যিকার অর্থেই এক উৎসবের দিন। স্থানীয়রা চান, প্রতিবছর এ ধরনের আয়োজন হোক এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকুক গ্রামীণ ঐতিহ্য।

এফএস