দিনরাত এক করে সীমান্তে কড়া প্রহরা ভারতীয় সেনাদের। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা এলাকার কুপওয়ারা, পুলওয়ামা, সোপোরে, অনন্তনাগ, বারামুল্লা, পুঞ্চ, নওশেরা, সুন্দরবেনি ও আখনুর সেক্টরে শুক্রবার ভোরেও গুলিবিনিময় অব্যাহত ছিল পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে।
জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের ঘটনায় উত্তাপ কমছেই না দক্ষিণ এশিয়ার চিরবৈরী দুই প্রতিবেশীর। হামলার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানের ওপর দায় চাপালেও এখনও প্রমাণ সরবরাহ করতে পারেনি ভারত সরকার, অভিযোগ ইসলামাবাদের।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি'র খবর, হামলার পর থেকে ২৮শ'র বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা-এনআইএ। আরও অনুসন্ধানের জন্য হেফাজতে রয়েছে দেড়শ'র বেশি মানুষ।
এনআইএ'র প্রাথমিক প্রতিবেদনে ২২ এপ্রিলের হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও নিষিদ্ধ সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে। ব্যাপক ফরেনসিক ও ইলেক্ট্রনিক তথ্য সংগ্রহের কথা জানিয়েছে এনআইএ।
ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত ৪০টির বেশি কার্তুজ পাঠানো হয়েছে ব্যালিস্টিক ও রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য। এতকিছুর পরও হামলার ১০ দিন পেরিয়ে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে হামলাকারীরা, বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়েছে ভারতের রাজনীতিতে।
ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘ঠাণ্ডা মাথায় কতগুলো মানুষকে হত্যা করা হলো। এটা স্পষ্ট যে এসবের পেছনে কারা আছে। জড়িতদের অবশ্যই চড়া মাশুল দিতে হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ধরনের বিভ্রান্তি ছাড়াই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এভাবে অলস সময় নষ্ট করতে পারেন না। ভারত যে এ ধরনের অপকর্ম সহ্য করবে না, সেটা তাকেই স্পষ্ট করতে হবে।’
এনআইএ বলছে, হামলার কয়েকদিন আগে পেহেলগাম ও আশপাশের এলাকায় স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। বারিসারান উপত্যকার ভেতরে ও বাইরে অন্তত তিনটি স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার হয়েছে নিয়মিত, যার মধ্যে দু'টির সংকেত শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করতে পেরেছে গোয়েন্দারা।
ঘটনাস্থলের ত্রিমাত্রিক ম্যাপিং এবং উপত্যকাজুড়ে সব মোবাইল টাওয়ারের ডাম্প ডেটাও বের করেছে সংস্থাটি। এসবের ভিত্তিতে পেহেলগাম হামলার সঙ্গে গেলো বছর সোনামার্গে ছয় শ্রমিক ও এক চিকিৎসকসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে বলেও দাবি করা হয় প্রতিবেদনে।
এমন পরিস্থিতিতে কাশ্মীরসহ দেশের প্রতিটি ইঞ্চি থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্যদিকে, বিতর্কিত উপত্যকার পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের প্রধানও ভারতের সাথে যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘কেউ যদি ভেবে থাকে যে কাপুরুষোচিত হামলা চালানো বিশাল কোনো অর্জন, তাহলে তাদের বুঝতে হবে, এটা নরেন্দ্র মোদির সরকারের আমল, যেখানে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ দেশের প্রতিটি ইঞ্চি থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা আমাদের দায়িত্ব এবং এ দায়িত্ব শতভাগ পালন করবো আমরা।’
পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট সুলতান মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পুরো আন্তর্জাতিক অঙ্গন, বিশ্বনেতারা এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের উচিত এগিয়ে আসা এবং কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতায় সহযোগিতা করা। দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরের মানুষ অনেক অনেক ভুগছে।’
দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরবৈরী প্রতিবেশী ও পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনার পারদ যতো চড়ছে, ততোই সীমান্তে সক্রিয়তা বাড়ছে দুই দেশের সেনাবাহিনীর। পাঞ্জাবে ঝিলাম শহরের কাছে তিল্লা ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের উপস্থিতিতে মহড়া চলে সামরিক মহড়া।
এর আগে মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের আরব সাগর উপকূলে মহড়ার ঘোষণা দেয় ভারতীয় নৌবাহিনী। এরই মধ্যে গুজরাটের হাজিরা বন্দরে ভিড়েছে গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার আইএনএস সুরাট। এ অবস্থায় দু'দেশকে আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, ‘যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, এমন বিষয় নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে তা যদি হয় দু'টি পরাশক্তি রাষ্ট্রের মধ্যে। ভারত ও পাকিস্তানে আমাদের মিত্রদের সাথে নিশ্চয়ই নিবিড় যোগাযোগ রাখছি আমরা। আশা করছি যে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না যার ফলে এ সংকট বড় ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেয়।’
চীনের আধিপত্য খর্বে দেশটির প্রতিবেশী ভারত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। আবার আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে বন্ধু দেশ হিসেবে গুরুত্ব কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রের তালিকায় বহাল আছে পাকিস্তানও। তাই সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দু্'দেশকে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছাতে বারবার আহ্বান জানাচ্ছে ওয়াশিংটন।
মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান। দু'দেশই উপত্যকার আংশিক নিয়ন্ত্রণ করছে এবং পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবিতে জড়িয়েছে একাধিক যুদ্ধে।