পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু; সময় লাগবে তিন থেকে পাঁচ বছর

বিগত সরকারের সময় পাচারকৃত অর্থের গন্তব্যে শীর্ষ ১০ দেশের একটি যুক্তরাজ্য
বিদেশে এখন
0

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও স্বজনদের যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি জব্দের ঘটনায় খুশি ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটি। তবে পাচারকৃত অর্থ দেশে না ফেরা পর্যন্ত চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অনেকে। অর্থের পূর্ণাঙ্গ তথ্যপ্রমাণ না থাকলেও বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ ও দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। যা বাস্তবায়নে সময় লাগবে তিন থেকে পাঁচ বছর।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির তথ্য বলছে, আওয়ামী সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হয়েছে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা। পাচারকৃত অর্থের গন্তব্যে শীর্ষ ১০ দেশের একটি যুক্তরাজ্য।

তিন মহাদেশজুড়ে সম্পদের পাহাড় ও বিলাসবহুল জীবন নিয়ে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের ঘিরে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়ে উঠেছিল টক অফ দ্য কান্ট্রি। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর শুধু যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি নিয়ে তোলপাড় হয় সারা দেশে। সেই সাম্রাজ্যে এবার নাড়া দিলো ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এনসিএ।

চলতি মাসের শুরুতে ব্রিটিশ আদালতের নির্দেশে সাইফুজ্জামানের বেশ কয়েকটি সম্পত্তি জব্দ করে এনসিএ। সাইফুজ্জামানের প্রকৃত সম্পত্তির কী পরিমাণ জব্দ হয়েছে, সেটি অবশ্য এখনও নিশ্চিত নয়। যুক্তরাজ্যে বিদেশি নাগরিকের সম্পত্তি জব্দ, পরবর্তী পদক্ষেপ এবং সম্ভাব্য শাস্তি কী হতে পারে- এমন প্রশ্ন ছিল ব্রিটিশ আবাসন ও স্থায়ী সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট এই আইনজীবীর কাছে।

লন্ডনের প্রোপার্টি বিষয়ক আইনজীবী দেওয়ান মাহদি বলেন, ‘সব কিছু এখন ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে। এখানে কোর্ট অর্ডার আছে, অথরিটি আছে সুতরাং কোর্ট অর্ডারকে অমান্য করলে এর ফলাফল ভালো হবে না। এ ঘটনার শাস্তি হিসেবে জেল, জরিমানা আছে এরপর কোর্ট অর্ডার আসবে আপনার সব কিছু হস্তান্তর করে দিতে হবে। একজন মানুষ যতই মিলিয়নার হোক এইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে একদিনের মধ্যে ভিক্ষুক হয়ে যেতে পারে।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা ও ব্রিটিশ সরকারের এমন পদক্ষেপে সন্তোষ জানালেও, জব্দকৃত সম্পদের অর্থ দেশে না ফেরা পর্যন্ত বিষয়টিকে সফল মনে করছেন না ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকে।

লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘দুর্নীতিবাজের সম্পদ এই দেশে জব্দ হয়েছে এটা সুসংবাদ। গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেনের বিলিয়ন বিলিয়ন সম্পদ এই দেশে জব্দ হয়েছে। বাংলাদেশ খেটে খাওয়া মানুষের দেশ। তাদের সম্পদ এই দেশে জব্দ হওয়ার পর এটা যদি দেশে ফিরিয়ে নেয়া যায়, দুই দেশের সরকার যদি এই বিষয়ে কাজ করে তাহলে কার্যকর কিছু হবে।’

লন্ডনের আইনজীবি ও কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব নাজির আহমদ বলেন, ‘পাচার করা অর্থ এই দেশে আসলো আর জব্দ হয়ে গেল কিন্তু নিতে পারলেন না। দেশের জনগণের কোনো উপকার হল না, তাহলে তো কোনো লাভ হলো না। আমরা পুরোপুরি স্বাগতম জানাবো যখন সরকার তড়িৎ গতিতে এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে।’

বিগত সরকারের আমলে দেড় দশকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এ অর্থের বড় অংশ পাচার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারের শাসনামলে সর্বোচ্চ। পাচারকৃত অর্থের একটি বড় অংশ এসেছে যুক্তরাজ্যে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের লন্ডনের নয়টি সম্পত্তি জব্দের আদেশ মিলেছে বলে গেলো ২৩ মে জানায় এনসিএ।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন প্রক্রিয়া জটিল হলেও পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরানো সম্ভব। প্রোপার্টি বিষয়ক আইনজীবী দেওয়ান মাহদি বলেন, ব্রিটিশ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইনে পড়লে এই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে। আর বাংলাদেশ যদি এখানে একটা পার্টি হয়ে এইটা নেয় তাহলে বাংলাদেশ এখানে একটা পার্টি থাকবে। এটা নির্ভর করবে কোন ওয়েতে পরবর্তী প্রসেস ফরমুলেট করা থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধে ব্রিটিশ সরকারের এই পদক্ষেপকে অর্থপাচারবিরোধী তদন্তের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাচারকৃত অর্থের পূর্ণাঙ্গ তথ্যপ্রমাণ না থাকলেও বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে বিদেশে থাকা এসব সম্পদ জব্দ ও দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দালিলিক প্রমাণ লাগবে। মুখের কথায় হবে না। সেই প্রমাণগুলোকে যদি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে না পারি তাহলে কন এজেন্সিই সেটা সিরিয়াসলি নিবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এসেট ফিট করা। যত বেশি করা যায়, যতগুলো দেশে করা যায়। তার পরবর্তী কার্যক্রম হচ্ছে আইনের মাধ্যমে এই এসেটগুলো ফিরিয়ে আনা।’

ইএ