ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০০ দিন বিভ্রান্তি আর বিতর্কে ভরা

উত্তর আমেরিকা
বিদেশে এখন
0

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০০ দিন। কেমন গেলো ‘খ্যাপাটে’ খ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম শত কর্মদিবস? বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদটিতে যাত্রাকালে যিনি তটস্থ করে রেখেছেন বিশ্ববাসীকে। ধ্বংসাত্মক বাণিজ্যযুদ্ধ উসকে দেয়া থেকে শুরু করে নিয়েছেন একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ, বিশ্বনেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রকে করেছেন আত্মঘাতী। হেঁয়ালি আর বিভ্রান্তিতে পূর্ণ এ চরিত্রকে বুঝতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন খোদ বিশ্বনেতারাই।

রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকেই সংবাদে নিয়মিত শিরোনাম। ধারা অব্যাহত আছে দ্বিতীয় মেয়াদেও। প্রেসিডেন্সির প্রথম ১০০ দিন পূরণ করলেন ৪৭তম মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদটিতে তার জয়ে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে উদ্বেগ ছিল যাদের, তাদের শঙ্কাকে কতটা বাস্তবে রূপ নিলো? ট্রাম্পবিরোধীদের ভয় যে অমূলক ছিল না, সেটাই যেন বারবার প্রমাণ করছেন খ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট।

ক্ষমতা গ্রহণের পর মুহূর্ত থেকেই সাংবিধানিক সংকটে ট্রাম্প প্রশাসন এবং স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা থেকে শুরু করে আদালত কক্ষের ভেতর থেকে দায়িত্বরত বিচারককে গ্রেপ্তার, ফেডারেল প্রসিকিউটরদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা ইত্যাদির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসনে সবচেয়ে বড় আঘাতটি করেছেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন জয়ী হয়ে ভোটের ফল উল্টে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, সে সময় প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা ট্রাম্প। প্রমাণ ছাড়া জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ থেকে শুরু করে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র ক্যাপিটল হিলে পার্লামেন্ট অধিবেশন চলার মধ্যে নজিরবিহীন দাঙ্গা উসকে দেন খোদ প্রেসিডেন্ট। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের অভিযোগ উত্থাপন এবং তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চেয়েছিলেন যারা, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তাদের লক্ষ্য করে মামলা থেকে শুরু করে একের পর এক প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন ট্রাম্প। উল্টোদিকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির এক হাজার ৬০০ হামলাকারীর জন্য।

২০২৪-এর নির্বাচনের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কামালা হ্যারিসের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে সিবিএসের সিক্সটি মিনিটসের বিরুদ্ধে মামলা, সরকারি তহবিলে পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ভয়েজ অব আমেরিকার অর্থ বরাদ্দ বন্ধে নির্বাহী আদেশ জারির মতো বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন রেডিও ফ্রি ইউরোপ, রেডিও লিবার্টি ইত্যাদি।

প্রথম মেয়াদেই সীমান্তে হাজার হাজার অভিবাসী পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন, যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হচ্ছে এবারও। ক্ষমতায় এসেই হাত-পা বেঁধে হাজারো অভিবাসীকে মার্কিন সামরিক বিমানে চড়িয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন দেশে, অনেকের জায়গা হয়েছে এল সালভাদরের কুখ্যাত কারাগারে। বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের সুরক্ষায় বিশেষ সুবিধা বাতিল করেছেন; অমানবিক প্রক্রিয়ায় অভিবাসীদের গণহারে বিতাড়নে ভুক্তভোগী হচ্ছেন বৈধরাও।

বিশ্বজুড়ে ধ্বংসাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ উসকে দিয়েছেন ট্রাম্প। মার্কিন অর্থনীতি রক্ষার নামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল আমদানি পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছেন। গেলো জানুয়ারি থেকে চলতি এপ্রিল মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক হার আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে, যা ১০০ বছরের বেশি সময়ে সর্বোচ্চ। প্রতিবেশী ও শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রায় সব দেশের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন ১০ থেকে ৫৪ শতাংশ; যার ফলে আবারও বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দা ঘনিয়ে আসছে বলে জোরালো হচ্ছে শঙ্কা।

শুল্কযুদ্ধের পাশাপাশি কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য করার হুমকি দিয়ে নিকটতম প্রতিবেশির সার্বভৌমত্বে আঘাত, সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে গ্রিনল্যান্ড ও পানামা দখলের হুমকি, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড বন্ধ করে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম বাতিল করা, উত্তর আটলান্টিক প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি- ইত্যাদি কারণে ভরসাযোগ্য মিত্রের অবস্থান হারিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র; নড়বড়ে হয়েছে মুক্ত বিশ্বে দেশটির নেতৃস্থানীয় অবস্থান।

এককালের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউক্রেনকে রীতিমতো চলন্ত বাসের নিচে ছুঁড়ে ফেলেছে ট্রাম্প প্রশাসন। রাশিয়ার তিন বছরের সামরিক আগ্রাসনে বিধ্বস্তপ্রায় দেশটির জন্য এ পর্যায়ে এসে বন্ধ করেছেন সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ। ইউক্রেন-রাশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিলেও রুশ সেনাবাহিনীর দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে ইউক্রেনকেই চাপ দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পূর্বসূরিদের রীতি ভেঙে রাশিয়ার প্রতি আন্তরিকতা দেখাতে গিয়ে পিছপা হননি বহুকালের ইউরোপীয় মিত্রদের বুড়ো আঙুল দেখাতেও। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলেও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে কিনে নিতে চেয়েছেন অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা, অন্ধকারে ছুঁড়ে দিয়েছেন ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ।

টিকাবিরোধী অবস্থানসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। আঘাত হেনেছে জাতির মেরুদণ্ড, তথা শিক্ষা। দেশের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করেছেন; বাতিল করেছে হার্ভার্ডসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ শত-কোটি ডলারের তহবিল। অভিযোগ রয়েছে, চরম বিতর্কিত এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রশাসনজুড়ে নিয়োগ দিয়েছেন ষড়যন্ত্রত্ত্বে বিশ্বাসী, ধর্মান্ধ, উগ্র, ট্রাম্পের প্রতি অন্ধবিশ্বাসী বিতর্কিত ব্যক্তিদের।

১৯৪০ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের পর প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয়বার নির্বাচনে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও এ লক্ষ্য সাধনে সংবিধান সংশোধনের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে ২০২৮-এর নির্বাচনের সময় ৮২ বছরে পা রাখতে যাওয়া এ নেতাকে।

সবমিলিয়ে হেঁয়ালি আর বিভ্রান্তিতে পূর্ণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চরিত্র ক্ষমতার শেষ পর্যন্ত আর কী কী করতে পারেন, তা বুঝতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মার্কিনিরা তো বটেই, সাথে সারা বিশ্বও।

এসএস