উপকূলীয় বনসহ দেশের সব বনভূমি সংরক্ষণে নীতি সংস্কারের দাবি

ব্লু ইকোনোমি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস কর্মশালা
দেশে এখন
0

দেশের বনভূমি ফিরিয়ে আনতে হলে বিদ্যমান আইনি কাঠামো সংস্কার এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আজ (সোমবার, ২৩ জুন) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁও-এ ‘ব্লু ইকোনোমি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও কোডেক আয়োজিত কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। কর্মসূচিতে সহযোগী ছিল, অক্সফ্যাম বাংলাদেশ ও বিটিএস (ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স)।

দেশের উপকূলীয় বনসহ সকল ধরণের বনভূমি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের স্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সরকারের বন রক্ষায় প্রণীত বিভিন্ন নীতিমালা, পরিকল্পনা ও আইনসমূহ পর্যালোচনা করে একটি নীতিগত প্রস্তাবনার খসড়া তৈরি করেছে। সেই প্রতিবেদন তুলে ধরতেই আয়োজন করা হয় এই কর্মশালার।

এতে সরকারি কর্মকর্তা, আইন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী, শিক্ষাবিদ ও উপকূলীয় এলাকার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন এবং উপকূলীয় বনসহ দেশের সব বনভূমি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যেখানে উভয় উপস্থাপক তাদের নীতিমালা ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জামগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় সাধন করেছে। এসডিএসএস টুলের মাধ্যমে বন ব্যবস্থাপনাকে সঠিক ও নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে এ টুলে আইনগত সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করাও অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রচলিত আইন ও বিধিমালায় সংশোধন এনে প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরি করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনগত সংশোধনের মাধ্যমে এই টুলকে একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যা বন ধ্বংসকারী মানবসৃষ্ট অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং বন সংরক্ষণকে আরও শক্তিশালী, সুনির্দিষ্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলবে।’

এ সময় অক্সফ্যাম বাংলাদেশের জলবায়ু এবং ভূ-স্থানিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ ইসমত এনানের স্পাশিয়াল ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম (এসডিএসএস) নামক স্থানিক বিশ্লেষণ টুলকিট নিয়ে একটি উপস্থাপনা করা হয়, যা উন্নত জিওএআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কার্যকর স্পাশিয়াল বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। টুলটির মাধ্যমে সরকার, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক এবং নীতিনির্ধারকেরা ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বনজ সম্পদের পর্যবেক্ষণে উন্নত সমাধান পেতে পারেন। উপস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ডেটা সরবরাহকারী বিশেষ করে সরকারি বিভাগগুলোর কাছে উচ্চমানের স্থানীয় তথ্য সরবরাহের জন্য আহ্বান জানানো হয়।

অক্সফ্যাম বাংলাদেশের জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞ এস এম সাইফি ইকবাল বলেন, ‘উপকূলীয় বন উজাড়ের প্রধান কারণ হচ্ছে মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ—যেমন অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটা, চিংড়ি চাষ ইত্যাদি। এর ফলে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে ম্যানগ্রোভ বন হারিয়ে যাচ্ছে। কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ধ্বংস প্রতিরোধ করা সম্ভব।’

বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, ‘সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে জীববৈচিত্র্যসহ বন রক্ষার কথা বলা হলেও, প্রকল্প প্রণয়নের সময় ভূমি ব্যবহার ও বন ধ্বংসের বিষয়টি সরকার মূল্যায়ন করে না। উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারে রেললাইন নির্মাণের জন্য ৭ লাখ ২০ হাজার গাছ ও ২৬টি পাহাড় কাটা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বন আইন ১৯২৭-এ ‘বন’-এর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সম্পর্কেও পরিষ্কার নির্দেশনা নেই। সহ-ব্যবস্থাপনাকে বাস্তবায়নে ২০০৪ সালের সামাজিক বনায়ন বিধিমালা এবং ২০১০ সালের সংশোধনী কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হয় না।’

তাসলিমা ইসলাম সুপারিশ করেন অন্যান্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বন আইনের সমন্বয় সাধন, ২০২৪ সালের বন নীতি সংশোধন, বনের মালিকানা পুনর্গঠন, বন উজাড়ের দায় নির্ধারণ ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং উপকূলীয় বন সংরক্ষণের জন্য আলাদা নীতি প্রণয়ন।

অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব (উন্নয়ন) জেকব ডি লিওন বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় আইন বিদ্যমান থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ দক্ষ জনবলের ঘাটতি এবং আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা।’

প্যানেল আলোচক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘সহ-ব্যবস্থাপনায় বনবাসীদের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব রয়েছে, অথচ বহু বছর ধরে প্রজেক্ট চলছে। আরেকজন প্যানেল আলোচক ড. আখতার মনে করেন কোথায় গ্যাপ রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।’

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বন বিভাগের সিসিএফ সানাউল্লাহ বলেন, ‘বন বিভাগ ও ভূমি প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ আরও বাস্তবভিত্তিক ও ফলপ্রসূ হবে।’

উল্লেখ্য, ‘ব্লু ইকোনোমি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ প্রকল্পটি দেশের পাঁচটি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে—খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর এবং কক্সবাজারের চকরিয়া ও মহেশখালীতে। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের মোট ভূমির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা জরুরি। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ ও দরিদ্র দেশে জীবিকা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বনভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উপকূলীয় বনভূমির বিকল্প নেই।

এএইচ