শহিদ জাকির হোসেনের মা মিছিলি বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে তো আর ফিরবে না। তার কবরের পাশে এখন মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পেয়েছি, এটাই শান্তি। বাকি জীবনটা এই কবরটার যত্ন নিয়েই কাটিয়ে দেব।’
নেত্রকোণার দুর্গাপুরের প্রত্যন্ত বাকলজোড়া গ্রামের মিছিলি বেগমের একমাত্র সন্তান জাকির হোসেন। স্বপ্ন ছিলো নিজের উপার্জনের টাকায় গ্রামে মায়ের জন্য তৈরি করবেন ঘর, কিনে দিবেন সামান্য জমি। স্বপ্নের অর্থ খুঁজতে নেত্রকোণা থেকে ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছিলো রাজধানী শহর ঢাকায়। ব্যস্ত নগরীর হাজারো কর্মব্যস্ত মানুষের মতই সামান্য শ্রমিকের কাজ জুটে ছিলো শহিদ জাকির হোসেনের।
সামান্য আয়, তাতেই নিজের খরচ মিটিয়ে বাকিটুকু পাঠাতেন মায়ের কাছে। ঘাম ঝরানো কষ্টের টাকার সামান্য সুখ যেন বেশি দিন স্থায়ী হলো না। চব্বিশের জুলাই আন্দোলনেই থমকে গেছে শহিদ জাকির হোসেনের জীবন আর স্বপ্নের যাত্রা।
চব্বিশের ২১ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে কাঁচপুর এলাকায় ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের চালানো গুলিতে নিহত হন শহিদ জাকির হোসেন। গ্রামে নিজের সামান্য আয়ে কেনা জমিতে সমাধিস্থ হয়েছে জাকির। তবে মৃত্যুর প্রায় এক বছরেও একমাত্র ছেলেকে হারানো যন্ত্রণায় পুড়ছে মা মিছিল বেগম। পাগল প্রায় মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিলো ছেলের কবরের পাশেই যেন মিলে আশ্রয়। মৃত্যুর এক বছরের মাথায় জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে ছেলের কবরের পাশেই পাকা নতুন ঘর তৈরি করে দিচ্ছে প্রশাসন।
রঙিন টিনের এ বাড়িতে রয়েছে থাকার জন্য দুই ঘর, রান্না ঘর, বারান্দা, টয়লেট সহ বিশুদ্ধ খাবার পানির সুবিধা। অনেকটা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের আদলে তৈরি এ বাড়ি। এছাড়াও কবরের চারপাশে রয়েছে কিছুটা খোলা জায়গাও। উদ্বোধনের পর বাড়িটি ঘুরে দেখেন জেলা প্রশাসন সহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
আর ছেলের কবরের পাশে ঘর পেয়ে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিলি বেগম বলেন, ‘সরকার একটা ঘর দিছে আমার ছেলের কবরের সামনে। কবরটা যেন হেফাজতে রাখতে পারি অন্তত এটা দেখতেই আমার শান্তি। আমার আর মনের কোন আশা নেই। আমি হোটেলে কাজ করে আমার ছেলেকে মানুষ করেছি। ১২০ টাকার সামান্য চাকরি করতাম তাতেই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থেকে বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোন রকমে জীবন চালিয়েছি। কিন্তু ছেলেটা বড় না হতেই চলে গেল। এই দিন আমি কেন দেখলাম। আল্লাহ আমার ছেলেরে রাখতো আমি চলে যেতাম। আমার ছেলে জীবিত থাকতো।’
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘নেত্রকোণা জেলায় জুলাই বিপ্লবে ১৭ জন শহিদ হয়েছেন এর মধ্যে জাকির হোসেন একজন। জাকির হোসেন দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমরা তার আত্মত্যাগকে মনে রাখবো। জাকিরের একমাত্র মা রয়েছে, তার যেন কোন অসুবিধা না হয় সে বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি। আমরা আগেই ঘোষণা দিয়েছিলাম যাদের ঘর নেই তাদেরকে ঘর করে দেব। আমরা জেলায় চারটি ঘর নির্মাণ করেছি এর মধ্যে জাকির হোসেনের মায়ের ঘর একটি। জাকির হোসেনের মায়ের কাছে আমরা ঘরটি হস্তান্তর করে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটাই অনুরোধ এখানকার স্থানীয় যারা রয়েছেন তারা খোঁজ-খবর রাখবেন যাতে করে জাকিরের মা কোন সমস্যায় না পড়েন। কেননা গৃহ নির্মাণের জমিটাও কিন্তু বেদখল ছিলো। আমরা সেই অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করে এই গৃহটি নির্মাণ করে দিয়েছি। এখনো জমি রয়েছে যেটি বেদখল হয়ে রয়েছে। যেহেতু এই বৃদ্ধ মায়ের কেউ নেই সে কারণে দুর্বৃত্তরা সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে জাকির দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। তার মায়ের দায়িত্ব আমাদের সবার। সেই লক্ষ্য থেকেই আমরা এই গৃহটি নির্মাণ করে দিয়েছি। আর জাকিরের যে কবর রয়েছে সেটাও কিন্তু আমরা সরকারের তরফ থেকেই বাঁধাই করে দেব।’