২০২০-২১ অর্থবছরে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৩ একর জমির ওপর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতলাসুর গ্রামে নির্মাণ করা হয় টিনসেট ওয়াল বিশিষ্ট ২৫০টি ঘর। এ এলাকাটিকে জেলা প্রশাসন ওই সময় ‘স্বপ্ননগর’ আবাসন নামকরণ করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, আলফাডাঙ্গা উপজেলার চরকাতলাসুর এলাকায় ‘স্বপ্ননগর’ আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রবেশপথে কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও তার চেয়ে বেশি। সারিতে সারিতে থাকা ঘরগুলির প্রতিটি গলিতেও পানি প্রায় হাঁটু সমান। বেশিরভাগ ঘরের মেঝেতে ঢুকে পড়েছে নোংরা পানি। পানিতে তলিয়ে গেছে রান্না করার চুলা। এছাড়া পানিতে তলিয়ে গেছে টয়লেটের রিং-স্লাব। এতে নোংরা পানির দুর্গন্ধে অসহনীয় হয়ে পড়েছে পরিবেশ। ছোট শিশুরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না।
সুপেয় পানির অভাব ও নোংরা-দুর্গন্ধযুক্ত পানির স্পর্শে বেড়েছে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। একইসঙ্গে দেখা দিয়েছে সাপের উপদ্রব। সেখানে বসবাসরত বাসিন্দারা দিন এনে দিন খায়। পশু পালন, ভ্যানচালানো, কৃষি কাজ, টেইলার্সের কাজসহ নানা পেশায় জড়িত তারা। পানিবন্দি হওয়ার কারণে দিন এনে দিন খাওয়া বাসিন্দারা বেকার হয়ে পড়েছে। স্বপ্ননগরের বাসিন্দাদের ঘুম নেই, খাবার নেই, এর মধ্যে আবার সাপের প্রকোপ। প্লাবিত হওয়া ঘরগুলোতে বসবাসকারীদের ঘরে জ্বলছে না তিনবেলা চুলা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৪ নম্বর ঘরের বাসিন্দা জবেদা বেগম বলেন,‘মধুমতি নদীতে সাতবার বাড়ি ভাঙছে। পরে সরকার এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকার জন্য একটা ঘর দিয়েছে। কিন্তু এখানে এসেও চরম বিপাকে পড়েছি। ঘরের মধ্যে পানি। রান্না ঘর তলিয়ে গেছে। ঠিকমতো রান্নাবান্না করতে পারছি না আমরা। অর্থ সংকট আছে। তিন বেলার রান্না করার জায়গায় এক বেলা করে কোনোরকম বেঁচে থাকা লাগছে।’
স্বপ্ননগরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) বলেন, ‘পানি হওয়াতে সব জায়গায় তলায় গেছে। ক্ষেত খামারি যা করছিলাম সব পানির নিচে। দিন না খেয়েও যাচ্ছে, তিন বেলার জায়গায় এক বেলা খাচ্ছি, এখন ঘরে খাটের উপর বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নাই। তবে এর ভেতর সরকারিভাবে কেউ খোঁজখবর নিচ্ছে না।’
আরও পড়ুন:
ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে হয় উল্লেখ করে সেলিনা বেগম নামে এক নারী বলেন, ‘কয়েক দিন আগে একটি সাপ দেখতে পেয়ে ভয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে যায়। সাপ, পোকামাকড়ের ভয়ে রাতে না ঘুমিয়েও চোকির উপর বসে থাকতে হয়।’
দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিক্ষার্থী মীম খানম ও ফাতেমা খানম। তারা দুইজন স্থানীয় চর কাতলাসুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারা বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে স্কুলে যাই। কোনো কোনো সময় পানি দিয়ে যাওয়া আসার সময় পড়ে গিয়ে জামা-কাপড় ও বইখাতা ভিজে যায়।’
এদিকে শিখা বেগম নামের একজন বলেন, ‘আমার মেয়েডার সামনে এসএসসি পরীক্ষা দিবে। পানি বাড়ার কারণে পড়ালেখায় সমস্যা হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ প্রাইভেট পড়তে যেতে পারছে না।’
চর কাতলাসুর গ্রামের বাসিন্দা ও আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার মুদিদোকানী ফিরোজ মোল্যা বলেন, ‘গত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এ এলাকায় এত বন্যা হয়নি। আমার নিজের ঘরে খাটের ওপর পানি। বউ বাচ্চাদের বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। দোকানে তেমন বেঁচাকেনা নাই। আমার দোকানেও পানি উঠা উঠা ভাব।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. বিল্লাল মোল্যা বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা বসবাস করেন তারা খুব দরিদ্র মানুষ। তারা দিন আনে দিন খায়। তারা সকালে কাজে বের হয়, আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। সারাদিন তারা বাইরে থাকেন। কিন্তু এখন তারা ঠিকমতো কাজকর্ম যেতে পারছে না।’
আরও পড়ুন:
এ ব্যাপারে গোপালপুর ইউপি চেয়ারম্যান খান সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এরইমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দ্রুতই তালিকাটি শেষ করে উপজেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হবে। তবে সেখানে বসবাসকারীদের খোঁজখবর রাখছি।’
আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল ইকবাল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বপ্ননগর আশ্রয়ণ প্রকল্পে জলাবদ্ধতার খবর পেয়েছি। মধুমতি নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে সেখানে হাঁটু সমান পানি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভুক্তভোগীদের তালিকা করছেন। স্বপ্ননগরের বাসিন্দা ও মধুমতি নদীর ভাঙনে কবলে পড়া বাসিন্দাদের জন্য চার মেট্রিকটন চাল ও নগদ দুই লাখ টাকা সরকারি অনুদান পাওয়া গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ইনশাআল্লাহ আগামীকাল (মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট) থেকে চাল ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায়।’