ব্যবহৃত বাইক কেনার সময় যে বিষয়গুলো অবশ্যই চেক করবেন:
১. আইনি নথিপত্র ও বিআরটিএ যাচাই (Legal Documents & BRTA Verification)
বাইক কেনার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো এর মালিকানা স্বচ্ছ হওয়া।
রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট: আসল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (Original Registration Certificate/RC) নিজের হাতে নিয়ে পরীক্ষা করুন।
ডিজিটাল নম্বর প্লেট: বাইকের ডিজিটাল নম্বর প্লেট এবং ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ আছে কি না যাচাই করুন।
বিআরটিএ ডাটাবেস: বর্তমানে অনলাইনে বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টাল (BRTA Service Portal) থেকে বাইকের চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর মিলিয়ে তথ্য সঠিক আছে কি না দেখা যায়। কোনোভাবেই আউট অব ডেট ট্যাক্স টোকেন (Expired Tax Token) যুক্ত বাইক কিনবেন না।
২. ইঞ্জিনের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা (Internal Engine Health Check)
বাইকের বাইরের চাকচিক্য দেখে ইঞ্জিন বিচার করা অসম্ভব।
কোল্ড স্টার্ট টেস্ট: সকালে বাইকটি প্রথম স্টার্ট দিয়ে দেখুন (Cold Start Test)। যদি স্টার্ট নিতে দেরি হয় বা ইঞ্জিন থেকে অস্বাভাবিক ধাতব শব্দ আসে, তবে বুঝবেন ইঞ্জিনে বড় কাজ আছে।
স্মোক টেস্ট: সাইলেন্সার দিয়ে নীল বা সাদা ধোঁয়া বের হওয়া মানে ইঞ্জিনের পিস্টন রিং বা সিলিন্ডারে (Piston Ring/Cylinder Damage) সমস্যা।
গিয়ার শিফটিং: গিয়ার পরিবর্তন করার সময় যদি আটকে যায় বা স্মুথ না হয়, তবে ক্লাচ প্লেট (Clutch Plate Condition) দুর্বল থাকতে পারে।
৩. দুর্ঘটনা বা চুরির ইতিহাস যাচাই (Accident or Stolen History Verification)
কম দামে চুরির বাইক কিনে জেল হাজতে যাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।
পুলিশ ক্লিয়ারেন্স: সম্ভব হলে বাইকটির নম্বর দিয়ে নিকটস্থ থানায় কোনো মামলা বা চুরির ডায়েরি (Stolen Bike Entry) আছে কি না নিশ্চিত হয়ে নিন।
চেসিস ও ফ্রেম চেক: বাইকের প্রধান ফ্রেম বা চেসিসে কোনো ঝালাই (Welding) বা বাঁক আছে কি না দেখুন। এটি থাকলে বুঝবেন বাইকটি বড় কোনো সড়ক দুর্ঘটনার (Road Accident) শিকার হয়েছিল।
৪. ইলেকট্রনিক্স ও সাসপেনশন (Electronics & Suspension System)
আধুনিক বাইকে ইলেকট্রনিক্স অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিট (ECU): বাইকের মিটার কনসোলে কোনো এরর সিগন্যাল (Error Signal) আছে কি না দেখুন।
শক অ্যাবজর্ভার: বাইকের সামনে ও পেছনের সাসপেনশন বা শক অ্যাবজর্ভার (Suspension/Shock Absorber) থেকে তেল লিক করছে কি না এবং তা ঠিকঠাক বাউন্স করছে কি না পরীক্ষা করুন।
৫. মালিকানা বদলি প্রক্রিয়া (Ownership Transfer Process)
টাকা লেনদেনের আগে অবশ্যই বিক্রেতার সাথে মালিকানা বদলি বা ট্রান্সফার ফরম (Ownership Transfer Form/TTO) এবং বিক্রয় হলফনামায় স্বাক্ষর করিয়ে নিন। অনেক সময় বিক্রেতা পরবর্তীতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ফলে মালিকানা বদলিতে জটিলতা তৈরি হয়।
সেকেন্ডহ্যান্ড বাইকের মালিকানা বদলি না করলে আপনি যেসব বিপদে পড়তে পারেন
একটি ব্যবহৃত বাইক কেনার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মালিকানা বদল করা আইনি বাধ্যবাধকতা। আপনি যদি বাইকের নাম পরিবর্তন (Name Transfer) না করেন, তবে আপনি ও বিক্রেতা—উভয়ই বড় ধরনের আইনি ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। নতুন সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, মালিকানা পরিবর্তনের নিয়ম ভঙ্গ করলে বড় অংকের আর্থিক জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মালিকানা বদলি না করার ৫টি ভয়াবহ ঝুঁকি:
১. আইনি জটিলতা ও পুলিশি ঝামেলা (Legal Complications & Police Harassment)
যদি ওই বাইকটি নিয়ে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা (Road Accident) ঘটে বা ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা হয়, তবে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে বিআরটিএ ডাটাবেসের মূল মালিককে ধরবে। অর্থাৎ, বাইকটি আপনার দখলে থাকলেও বিপদে পড়বেন পূর্ববর্তী মালিক। আবার যদি বাইকটি কোনো অপরাধমূলক কাজে (Criminal Activities) ব্যবহৃত হয়, তবে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়বে যে বাইকটি মূল মালিকের নাকি আপনার।
২. মামলার জরিমানা ও ডিজিটাল মামলা (Traffic Case & Digital Fine)
বর্তমানে ই-প্রসিকিউশনের মাধ্যমে ডিজিটাল মামলা (Digital Traffic Case) দেওয়া হয়। যেহেতু বাইকের মালিকানা পরিবর্তন হয়নি, তাই সব মামলার নোটিশ এবং জরিমানা আগের মালিকের ঠিকানায় যাবে। এই জরিমানা পরিশোধ না করলে পরবর্তীতে বাইকটি জব্দ (Seizure) করতে পারে প্রশাসন।
৩. বাইক চুরি হলে জিডি করতে না পারা (Issues in Filing GD for Stolen Bike)
যদি আপনার বাইকটি যদি চুরি হয়ে যায় (Bike Theft), তবে আপনি থানায় জিডি (General Diary) করতে পারবেন না। কারণ, আইনিভাবে আপনি ওই বাইকের মালিক নন। বিআরটিএ-র কাগজ অনুযায়ী যিনি মালিক, কেবল তিনিই আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ফলে আপনার শখের বাইকটি ফিরে পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে যাবে।
৪. নথিপত্র রিনিউ বা হালনাগাদ করতে বাধা (Document Renewal Problems)
বাইকের ট্যাক্স টোকেন (Tax Token Renewal) বা ফিটনেস সার্টিফিকেট (Fitness Certificate Update) রিনিউ করতে গেলে মূল মালিকের স্বাক্ষর বা উপস্থিতির প্রয়োজন হতে পারে। যদি আগের মালিকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে আপনি বাইকের কাগজ আর হালনাগাদ করতে পারবেন না, যা বাইকটিকে অবৈধ করে তুলবে।
৫. ইন্স্যুরেন্স দাবি না পাওয়া (Insurance Claim Rejection)
বাইকের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতির জন্য যদি আপনি ইন্স্যুরেন্স বা বীমা দাবি (Insurance Claim) করতে চান, তবে মালিকানা না বদলালে আপনি এক টাকাও পাবেন না। বীমা কোম্পানি কেবল নথিতে থাকা মালিককেই ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।
৬. অবৈধভাবে মোটরযান চালানো ও মালিকানা সংক্রান্ত দণ্ড
সড়ক পরিবহন আইনের বিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি মালিকানা পরিবর্তন না করে বা বিআরটিএ-কে অবহিত না করে মোটরযান ব্যবহার করেন, তবে তিনি আইন অমান্যকারী হিসেবে গণ্য হবেন। আইনের ধারা অনুযায়ী, সঠিক নথিপত্র বা মালিকানা তথ্য ছাড়া বাইক চালালে ৫,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।গুরুতর ক্ষেত্রে বা বারবার একই অপরাধ করলে ১ মাস থেকে ৩ মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে।
৭. সঠিক তথ্য গোপন করার শাস্তি
যদি কেউ বাইকের মালিকানা বদলি না করে ভুয়া স্ট্যাম্প বা দলিলে বাইক ব্যবহার করেন, তবে তা জালিয়াতির আওতায় পড়ে। এক্ষেত্রে কারাদণ্ডের মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরও বাড়তে পারে।
৮. বিআরটিএ-র সময়সীমা ও বিলম্ব ফি (Late Fee)
নিয়ম অনুযায়ী, বাইক কেনার ৩০ দিনের মধ্যে মালিকানা বদলির আবেদন করতে হয়। এই সময় পার হয়ে গেলে প্রতি মাস বা বছরের জন্য অতিরিক্ত বিলম্ব ফি বা লেট ফি (Late Fee/Penalty) প্রদান করতে হয়, যা মূল ফি-র সাথে যুক্ত হয়ে আপনার খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
পরিশেষে বলা যায়, একটি সেকেন্ডহ্যান্ড বাইক কেনা আপনার খরচ কমাতে পারে ঠিকই, কিন্তু যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে তা আপনার জীবনের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেবল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর বা মৌখিক চুক্তিতে বিশ্বাস না করে, দ্রুততম সময়ে বিআরটিএ (BRTA)-এর মাধ্যমে মালিকানা পরিবর্তন সম্পন্ন করা একজন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব। মনে রাখবেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ আপনাকে জেল-জরিমানা ও অনাকাঙ্ক্ষিত আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখবে। আপনার শখের বাইকটি হোক আনন্দের উৎস, কোনো আইনি বোঝা নয়।





