পেহেলগাম ইস্যুতে সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে ভারত পানি যুদ্ধ শুরু করেছে বলে প্রথম থেকেই অভিযোগ পাকিস্তানের। এখন সেই চুক্তি অমান্য করে জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল থেকে ঝিলাম নদীতে স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি পানি ছাড়ছে ভারত। এমনটাই দাবি পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দাদের।
কোনো ধরনের আগাম বার্তা ছাড়া মাঝে মধ্যেই ভারত পানি ছেড়ে দেয়ায় আজাদ কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদের ঝিলাম নদীর তীরে বাড়ছে পাচ্ছে পানির স্তর। বন্যার শঙ্কায় উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দিন পাড় করছেন অঞ্চলটির হাজার হাজার বাসিন্দা। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় কৃষক ও মৎস্যজীবীরা।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘ভারত যখন পানি ছেড়ে দেয়, তখন নদীর পানি ৮-১০ ফুট বেড়ে যায়। তাই অনেক ভয় এবং অনিশ্চয়তা রয়েছে। কোনও সতর্কতা ছাড়াই আরো পানি ছাড়তে পারে বলে খবর পাওয়া গেছে।’
আরেকজন বলেন, ‘কেবল বেঁচে থাকার জন্য আমি নদীতে মাছ ধরে এলাকায় বিক্রি করি। গত সপ্তাহে আমি জাল ফেলেছি, কিন্তু দুই দিন পরে হঠাৎ পানির স্তর ১০ ফুট বেড়ে যায়। আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
আরো পড়ুন:
১৯৬০ সাল হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি একসময় দুদেশের মধ্যে সহযোগিতার বিরল প্রতীক হলেও পেহেলগাম ইস্যু ঘিরে এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যতই হুমকি-ধামকি দিক একতরফাভাবে সিন্ধু চুক্তি বাতিলের এখতিয়ার নেই ভারতের, এমনটাই মনে করেন আজাদ-কাশ্মীরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজা মুহাম্মদ ফারুক হায়দার খান।
পাকিস্তানের আজাদ-কাশ্মীরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজা মুহাম্মদ ফারুক হায়দার খান বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে, কিন্তু এই সিন্ধু পানি চুক্তি ত্রিপক্ষীয়। এটি কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়, বিশ্বব্যাংকও রয়েছে। চুক্তির ধারাগুলোয় বলা আছে, ভারত বা পাকিস্তান কেউই এটি থেকে সরে যেতে পারবে না। এই চুক্তি বাতিল করতে চাইলে তাদের পারস্পরিকভাবে একমত হতে হবে।’
অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়ালেও বহাল ছিল সিন্ধু চুক্তি। ২০১৬ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর সিন্ধু চুক্তি ঘিরে ভারত উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে বলে দাবি পাকিস্তানের।
তখন পানি সরবরাহ ব্যাহত করে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তির হুমকি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বলেছিলেন, রক্ত এবং পানি একসাথে প্রবাহিত হতে পারে না।
আরো পড়ুন:
পরে ২০২৩ সালে ইসলামাবাদকে একটি নোটিশও পাঠায় নয়াদিল্লি। এসব দিক বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২২ এপ্রিল পেহেলগাম ইস্যুতে হুট করেই সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়নি ভারত। এটি পূর্ব পরিকল্পিত।
চ্যাথাম হাউজের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রোগ্রাম গবেষক ড. চিতিগ বাজপেয়ী বলেন, ‘২০২৩ সালে চুক্তিটি পর্যালোচনা ও সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তানকে একটি আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠিয়েছে ভারত। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগও উত্থাপন করা হয়েছিলো। যাতে ঝিলাম ও চেনাব নদীর তীরবর্তী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে পানির প্রবাহ উজানে স্থানান্তরের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে ভারত। তাই এটি এমন কিছু নয় যা হঠাৎ করেই ঘটেছে, আগে থেকেই এটি নিয়ে উত্তেজনা চলমান ছিল।’
সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করার বর্তমান সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিকভাবে বড় প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভারতের সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা যেমন উত্তাপ ছড়িয়েছে, তেমনি পাকিস্তান ১৯৭২ সালে হওয়া সিমলা শান্তি চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েও উত্তেজনার পারদ বাড়িয়েছে বলে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. চিতিগ বাজপেয়ী বলেন, ‘উভয় পক্ষই স্পষ্টত লাল রেখা অতিক্রম করছে। তা সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার মধ্য দিয়ে হোক হোক কিংবা সিমলা শান্তি চুক্তি। আমি মনে করি এটি অবশ্যই দুদেশের মধ্যে ঝুঁকি এবং উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে।’
চুক্তির মাধ্যমে সিন্ধু অববাহিকার পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী রাভি, বিয়াস ও শতদ্রু'র পানি ব্যবহারে অনুমতি পায় ভারত। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদ–নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের পানি পায় পাকিস্তান। যার উপর পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ সেচ ও কৃষি নির্ভরশীল।