সাবেক কংগ্রেস নেতা হেমন্ত ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপিতে যোগ দেন ২০১৫ সালে। তারপর থেকেই মুসলিম বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নিয়মিত সংবাদের বিষয়বস্তু তিনি।
তুরস্ক ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি'র প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে কয়েক দশক ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে ২০ কোটির বেশি মুসলিম। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে পরিস্থিতি কেবল খারাপই হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে তাহলে আলোচনায় আসাম কেন?
সম্প্রতি আসামের গোয়ালপারায় পাইকান সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বনবিভাগের সহযোগিতায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় রাজ্য পুলিশ। প্রশাসনের দাবি, উচ্ছেদ চলছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে। অভিযানের সময় এক মুসলিম নিহত এবং আহত হয় আরও অনেকে। উত্তেজনার সূত্রপাত, যখন বাসিন্দারা জোরপূর্বক উচ্ছেদে বাধা দেয়। বিক্ষুব্ধদের বড় অংশই বাংলাভাষী মুসলিম।
বিক্ষোভকারী একজন বলেন, ‘আজ হয়তো আমি মরে যাবো। আমার লড়াই থেমে যাবে। কিন্তু আমার নাতিপুতিরা তোমাদের শেষ দেখে ছাড়বে।’
রাজ্য সরকারের ভাষ্য, বনের ১৪০ হেক্টর জমি পরিষ্কার করতে চায় কর্তৃপক্ষ, যেখানে বাস এক হাজার ৮০টি পরিবারের। বেশিরভাগই মুসলিম বাঙালি। উচ্ছেদের শিকার বাসিন্দারা বলছেন, অঞ্চলটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণারও অনেক আগে থেকে সেখানে বসবাস তাদের।
টিআরটি বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কার্যক্রম এবং উস্কানিমূলক বক্তব্যে ইঙ্গিত মেলে যে, রাজ্য জনসংখ্যার চিত্র বদলে দিতে এবং কট্টর হিন্দুদের সহানুভূতি অর্জনে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ এই বাঙালি মুসলিমদের অপসারণ। সাম্প্রতিক উচ্ছেদ কার্যক্রমের আগে গেলো ১৬ জুন গোয়ালপারার কাছেই, হাসিলাবিল জলাভূমি এলাকাতেও একই অজুহাতে চলে উচ্ছেদ। সেখানেও কমপক্ষে ৬৯০টি পরিবারের বেশিরভাগই বাঙালি মুসলিম এবং তাদের সরাতেও দেয়া হয় অবৈধ তকমা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে চলতি সপ্তাহেই হেমন্ত লেখেন, বন আর আদিবাসীদের জমির অধিকার রক্ষায় অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। যদিও অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন তুলে আসছেন বিরোধীরা। সমালোচকদের অভিযোগ, ভূমি দখল বা অবৈধ বসতির দোহাই দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে উচ্ছেদ কিংবা সরাসরি স্থাপনা ধ্বংসের কার্যক্রম বাড়ছে; ভুক্তভোগী মুসলিম জনগোষ্ঠী।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী নয়া দিল্লিতে কয়েকশ' বছরের পুরোনো একটি মসজিদও একই অজুহাতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ মসজিদটি নির্মাণের সময় ভারত রাষ্ট্রেরই অস্তিত্ব ছিল না, ছিল না সংলগ্ন এলাকায় কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলও। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছে ২০২৪ সালে।
এমন প্রেক্ষাপটেই উচ্ছেদ অভিযান সামনে এগিয়ে নিতে অনড় আসাম মুখ্যমন্ত্রী। কোনো ধরনের বিরোধিতা তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারবে না জানিয়ে গত ৮ জুলাই তিনি বলেন, ৩৫০ বাংলাদেশিকে অপসারণে আপত্তি জানালে ফল ভোগ করতে হবে। রাজনীতিতে তার যাত্রার বড় অংশজুড়ে রয়েছে মুসলিম বিরোধিতার অভিযোগ। বিরোধীরা বলছেন, নিজেদের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনাকে আড়ালে রাখতে ভূমি দখলমুক্ত করার নাটক করছেন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী।
আসামের কংগ্রেস নেতা গৌরব গগই বলেন, ‘ওই সরকারি জমিগুলোর তথ্য গোপন করছে রাজ্য সরকার। ওসব জমিগুলো আসলে বিজেপি নেতা, মন্ত্রী আর বিধায়করা দখল করছে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে। জমিগুলো নিয়ে খুব সফলভাবে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে কংগ্রেস। ভূমি দখল আর অন্যান্য কেলেঙ্কারির আড়ালে নিজেদের স্ত্রী ও পরিবারের দুর্নীতির তথ্য লুকাচ্ছে। তাই নিজেদের অপশাসন ও দুর্নীতি থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে এসব করছে তারা।’
আসামের মুসলিমদের বারবার লক্ষ্য করেছেন হেমন্ত, বিশেষ করে যারা বাঙালি বংশোদ্ভূত, তাদের তিনি অভিহিত করেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে। বাংলাদেশে গেলো বছর আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিজের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান আরও স্পষ্ট করেন তিনি। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাসরত বাসিন্দাদের দাবির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দাবিও স্পষ্টই সাংঘর্ষিক।
বিভিন্ন সময় হেমন্তর আরও কিছু অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সবজির দাম বৃদ্ধি এবং বন্যার জন্য দায়ী মুসলিমরা। যদিও এসব অদ্ভুত অভিযোগের কোনো প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। কিন্তু এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে অনেক আসমীয় জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী হুমকি ধামকি দিচ্ছে মুসলিমদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে।
তিনি বলেন, ‘আদিবাসী এলাকাগুলোতে হেমন্ত সরকারের এই উচ্ছেদ অভিযানে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে।’
এমন পরিস্থিতিতে হেমন্তর উচ্ছেদ অভিযানের শিকার কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন এবং পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। ভারতীয় ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম স্ক্রলের তথ্য, শুধু গেলো মাসেই আসামের চার জেলায় পাঁচটি উচ্ছেদ অভিযানে আশ্রয়হীন হয় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তথ্য, গেলো ৮ জুলাই রাজ্যের অন্যতম বড় উচ্ছেদ অভিযান চলে ধুবরি জেলায়। সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয় ১৪শ' পরিবারকে।
সাম্প্রতিক উচ্ছেদ অভিযানের ফলে সহিংস বিক্ষোভের শঙ্কা বাড়ছে আসামে। অভিযানের সমালোচনা করেছেন রাহুল গান্ধীসহ ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির শীর্ষ নেতারাও। আসামে এ ধরনের বিক্ষোভ নতুন নয়। ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং সম্প্রতি মুসলিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় রাজ্যটিতে।