ইসরাইলের এমন পদক্ষেপে হামাসের পাশাপাশি তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে, নেতানিয়াহু ও ইয়োভ গ্যালন্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জেরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারক ও প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
একদিকে ইসরাইলি বাহিনীর হামলার ভয়, অন্যদিকে ত্রাণের অভাবে অবরুদ্ধ গাজায় ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। আর বোমা হামলা ও দুর্ভিক্ষে মৃত্যু তো আছেই।
প্রায় ২২ মাস ধরেই এমন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন ফিলিস্তিনিরা। এর সঙ্গে মরার ওপর খারার ঘা হয়ে এসেছে পুরো গাজা সিটি দখলে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান। বুধবার মধ্যরাত থেকে অসহায় গাজাবাসীর ওপর শুরু হয়েছে ভয়াবহ হামলা।
প্রথম ধাপের পরিকল্পিত এ আগ্রাসনে প্রায় ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা মোতায়েন করেছে নেতানিয়াহু সরকার। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, এরইমধ্যে জয়তুন ও জাবালিয়া শহরে অভিযান শুরু হয়েছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা পুরো গাজা সিটি দখল ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত স্থল অভিযানের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছে এবং এরইমধ্যে শহরের উপকণ্ঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এক সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন, সেনারা এরইমধ্যে জেইতুন ও জাবালিয়া এলাকায় অভিযানে নেমেছে, যা আসন্ন অভিযানের ভিত্তি তৈরি করছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফ্রিন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে প্রথম দফায় গাজা শহরে আক্রমণ শুরু করেছি। ইতোমধ্যেই গাজা শহরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে সেনারা অভিযান চালাচ্ছে। গোপন সুড়ঙ্গে হামাসের অবস্থান লক্ষ্য করেই মূলত হামলা চালানো হচ্ছে।’
ইসরাইলি বাহিনীর ভয়াবহ এ আগ্রাসন থেকে বাঁচতে আবারও গাজাবাসীকে ছুটতে হচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আর এতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ফিলিস্তিনিরা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ কেউই এই সংকটে সমাধান করতে পারছে না বলে আক্ষেপ লাখো মানুষের।
গাজার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘ছুটতে ছুটতে আমরা ক্লান্ত। প্রতিদিনই এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে হয়। হরহামেশাই শোনা যায়, অতিরিক্তি ইসরাইলি সেনা মোতায়েন করা হবে। অভিযান চালাতে এবার সত্যি সত্যি রিজার্ভ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।’
অপর একজন বাসিন্দা বলেন, ‘কোথাও যাবো জানি না। গাজার ২০ লাখ মানুষের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। বাড়ি-ঘর ছেড়ে তাবুতে রাত কাটাই তারপরও আমাদের কোথাও ঠাঁই হয়না।’
আরও পড়ুন:
স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি হবে বলে আশায় ছিলাম। তবে এবার আগ্রাসনে মাত্রা আরও বাড়িয়েছে ইসরাইলিরা। প্রতিদিনই তাদের হাতে গাজার মানুষ নিহত হচ্ছেন। অমানবিক এই পরিস্থিতির কেউ সমাধান করতে পারছেন না।’
ইসরাইলির এ অভিযানে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে শঙ্কা জাতিসংঘের। সংস্থাটির মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস এমন পরিস্থিতিতে উপত্যকাটিতে আবারও দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেন, ‘বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে গাজা সংকট সমাধান হচ্ছে না। নিরাপত্তা পরিষদও কোন ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। যুদ্ধ থামাতে কোন ধরণের ভূমিকা রাখতে পারছে না জাতিসংঘ।’
ইসরাইলের এমন পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা। এছাড়াও, গাজা সিটি দখলের প্রচেষ্টা সবার জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে তেল আবিবকে সতর্ক করেছে ইসরাইলের অনেক মিত্রদেশ। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়িক নেতারা। তেল আবিবের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য বন্ধের দাবিও তোলেন তারা।
অনেক পশ্চিমাদেশ গাজা ইস্যুতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনও তাদের পুশ ইন করে যাচ্ছে। এবার গাজায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালন্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জেরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির দুই বিচারক ও দুই প্রসিকিউটরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে এতে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেন, ‘দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আইসিসি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারের একটি মূল স্তম্ভ এবং তাদের কাজকে সম্মান করি। আইসিসি কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত প্রসিকিউটরের কার্যক্রম ও আদালতের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক নীতি এবং একে অবশ্যই সম্মান করা উচিত।’
ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে হামাস রাজি হওয়া স্বত্বেও ইসরাইলের পক্ষ থেকে এখনও সারা মিলছে না বলে জানায় গোষ্ঠীটি। তবে আন্তর্জাতিক সব সমালোচনা উপেক্ষা করেই গাজায় অভিযান চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেল আবিব।
এদিকে হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে ইসরাইলজুড়ে। নেতানিয়াহু সরকারের পতনেরও দাবি তোলে বিক্ষোভকারীরা।