তার আদালতে যারা যেত, তারা ভয় নিয়ে যেত ঠিকই, কিন্তু ফিরত চোখে জল নিয়ে। সে জল হতো কৃতজ্ঞতার। তার রায় ছিল অন্যরকম। সে রায়ে আইন ছিল, কিন্তু তার পাশে জুড়ে থাকতো মানুষ দেখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা।
সেই মানুষটি আর নেই। গতকাল (বুধবার, ২০ আগস্ট) ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বিচারক ক্যাপ্রিও। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন লড়েছেন প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের বিরুদ্ধে। এ লড়াইয়ের কথা তিনি নিজেই জানিয়ে গিয়েছিলেন তার শেষ ভিডিওগুলোতে।
বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, প্রার্থনার শক্তি অসীম। চিকিৎসা চলছে, তবে আপনাদের দোয়া চাই।’
এ শেষ চাওয়াটুকুও ছিল বিনয় আর মানবিকতায় পূর্ণ, যেমনটা ছিল তার সারাজীবনের বিচার দর্শন।
‘কট ইন প্রোভিডেন্স’ শুনতে একটা সাধারণ ‘টিভি শো’- এর নাম। কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে ছিল প্রতিদিনকার জীবনের বাস্তব গল্প। সেখানে একজন মা বলছেন ‘ছেলেকে স্কুলে দিতে গিয়ে পার্কিং নিয়ম ভেঙেছি। তখন পকেটে শুধু ডায়াপারের টাকাটা ছিল।’
ক্যাপ্রিও বললেন, ‘তুমি ভুল করেছো ঠিকই, কিন্তু ডায়াপার কেনার সিদ্ধান্ত ছিল তোমার শ্রেষ্ঠ কাজ।’
এ একটি বাক্যেই বিচার হয়ে গেল। আর বিচারক হয়ে উঠলেন এক মমতাময় পিতা, যিনি শাসনের চেয়ে বুঝতে ভালোবাসতেন।
একদিন এক বৃদ্ধ বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি গাড়ি দ্রুত চালিয়েছি, কারণ আমার ছেলে ক্যানসারে আক্রান্ত। তাকে হাসপাতালে নিতে হচ্ছিল।’
ক্যাপ্রিও বললেন, ‘আপনার জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম।’
এসব মুহূর্ত শুধু একটি দেশের আদালতকক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো দেখেছে বাংলাদেশও। বাংলা অনুবাদে ভিডিওর নিচে হাজারও মন্তব্যে দেখা গেছে ‘এমন বিচারক যদি আমাদের দেশেও থাকতেন!’
ক্যাপ্রিওর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৩ নভেম্বর, রোড আইল্যান্ডের প্রভিডেন্সে। বাবা ছিলেন একজন দুধ বিক্রেতা। বড় হয়েছেন খুব সাধারণ পরিবেশে। দিনে স্কুলে সরকার ও সংবিধান পড়াতেন, রাতে পড়তেন আইন। পরে সাফল্যের সঙ্গে পাশ করে উঠে আসেন বিচারকের আসনে।
আরও পড়ুন:
তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে প্রভিডেন্স মিউনিসিপাল কোর্টে বিচারক ছিলেন টানা ৪০ বছর ধরে। ২০২৩ সালে অবসরে যান।
বিচারক হয়েও নিজেকে কখনও ‘ক্ষমতার মানুষ’ ভাবেননি। বরং নিজেকে বলতেন ‘আমি একজন সেবক। আমার কাজ শুধু রায় দেয়া নয়, মানুষকে বোঝা।’
তার বিচার নিয়ে তৈরি হওয়া শো ‘কট ইন প্রোভিডেন্স’ আমেরিকায় চারটি ডে-টাইম এমি অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন পায়। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল মানুষের ভালোবাসা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ৮৭তম জন্মদিনের কিছুদিন পর, তিনি একটি ভিডিও বার্তায় জানান, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। বলেছিলেন, ‘এই ক্যানসার খুবই ভয়ঙ্কর। কিন্তু আমি ভয় পাই না। আমি লড়াই করবো।’
২০২৪ সালের মে মাসে শেষ রেডিয়েশন শেষ করে তিনি হাসিমুখে হাসপাতালের ঘণ্টা বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি লড়ছি, কারণ আপনারা আমার পাশে আছেন।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই রোগই তাকে থামিয়ে দিল। মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে তিনি একটি শেষ ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন, ‘আবার বলছি, দোয়া করবেন, যদি পারেন।’
এ অনুরোধে কোনো অহংকার ছিল না, ছিল কেবল এক বর্ণিল জীবনের বিনীত সমাপ্তি।
ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিওর মৃত্যুতে আমেরিকা হারালো এক অনন্য বিচারককে। আর এ পৃথিবী হারাল এক শিক্ষককে, যিনি শিখিয়েছেন, বিচার মানে কেবল আইন জানা নয়, বিচার মানে হৃদয়ে জায়গা দেয়া।
তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী জয়েস, পাঁচ সন্তান, সাত নাতি-নাতনি ও দুইজন প্রপৌত্র। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার রয়ে গেছে পৃথিবীর কোটি মানুষের হৃদয়ে।
আমরা যখন প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখি, কেউ আইনের জোরে দুর্বলকে চেপে ধরছে, তখন ক্যাপ্রিও আমাদের মনে করিয়ে দেন আইনও কোমল হতে পারে। আদালত শুধু ভয়ের স্থান নয় এটিও হতে পারে আশ্রয়ের।
তিনি বলতেন, ‘মানুষকে তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন দিয়ে বিচার করো না।’
এ কথাটিই যেন তার জীবনের সারাংশ।