১৯ জুলাই, ২০২৪। উত্তাল শহর, থমথমে পুরো রাজধানী। কাফরুলের হাউজিং স্টাফ কোয়ার্টারের নিজ কক্ষে গল্পে, খেলায় মেতেছিল ১১ বছরের সাফকাত সামির। হঠাৎই পাশের রাস্তায় শুরু হয় গোলাগুলি। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে যায় ঘর। এরপরই জানালা আটকাতে গেলে ঘটে যায় বিয়োগাত্মক ঘটনা।
শহীদ সামিরের চাচা ইমন বলেন, ‘হঠাৎ করে বিকট একটা শব্দ হয়। আমি তো ঝুঁকে গেছি, এর সাথে সাথে আমার বোন সামির বলে চিৎকার দিয়ে উঠছে। পুরো রুমে দেখলাম দেয়ালে গুলি লেগে সিমেন্টের বালু ছড়িয়ে গেছে। আর দেখলাম সামির টেবিলের ওপর থেকে মেঝেতে পড়ে রক্তে মেখে গেলো।’
ছেলের ব্যবহৃত জিনিসেই হারানো ধন খুঁজে ফেরেন শহীদ সামিরের বাবা সাকিবুর। পুরো ঘরজুড়ে ছেলের আঁকা বাংলাদেশের পতাকা, প্রথম শেখা অক্ষরের স্মৃতিচিহ্ন।
শহীদ সামিরের বাবা সাকিবুর রহমান বলেন, ‘একটা বাবার সামনে তার সন্তানের চোখ দিয়ে মগজের অংশ বের হয়ে যাওয়ার চেয়ে খারাপ দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না। আমার জীবনে এমন দৃশ্য সিনেমাতেই দেখছি। কিন্তু এটা একটা মানুষের জীবনে ব্যক্তিগতভাবে হতে পারে, এটা আমার আইডিয়া ছিল না।’
মিরপুরের রাজপথ উত্তাল হয় এরও তিন দিন আগে, ১৬ জুলাই। সেদিন মিরপুর ১০ গোল চত্বরের সড়ক অবরোধ করলে এভাবেই শিক্ষার্থী সাইফকে ঘিরে ধরে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। শুরুর দিকে পুলিশের ঢাল হিসাবে আন্দোলন দমাতে মাঠে নামে যুবলীগের নিখিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাচ্চু ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যদের নেতা-কর্মীরা।
জুলাই আন্দোলনে আহত সাইফ বলেন, ‘ছোট বাচ্চারা, সর্বোচ্চ ক্লাস নাইন-টেন এ পড়ে এমন হবে। সে আমাকে এসে বলছে, ভাইয়া এখানে আশেপাশে কোনো ফার্মেসি আছে, আমার মনে হয় গুলি লাগছে। আমি বললাম যে জামাটা খোলো। যখন জামাটা খুলে, তখন দেখি যে হাত থেকে মাংস নাই হয়ে গেছে।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মিরপুরে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো মিরপুর ১০। গোল চত্বর এবং আশেপাশের অলিগলি ঘিরে স্লোগান, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং সংগ্রামের দিনলিপি রচিত হয়েছে। মিরপুরের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী প্রিয়ত।
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তখনই ১৬ তারিখ আমাদের বিইউবিটি এবং কমার্স কলেজের যৌথ উদ্যোগে প্রথম আন্দোলন হয় মিরপুর ১০ এ। কৌশলগত জায়গা থেকে দেখা গেছে যে আমরা ছয়টা থেকে সাতটা গ্রুপ ভাগ করে এখানে আন্দোলন করেছি। বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে গুলি করা হয়, পুলিশ লাইভ ফায়ার করতে শুরু করে। বিজিবি ছিল এখানে, বিজিবি ফায়ার করেছে।’
মিরপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের সামনের আন্দোলনের স্রোত নামে রাজপথে এসে মেশে ১৯ জুলাই। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মারণ ঘাতী অস্ত্রের ঝনঝনাতিতে ক্ষেপে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। সেদিন দুপুর ১টার পর মিরপুর ১০ গোল চত্বর দখলে নেন তারা। যা সমুন্নত রাখতে লড়াই চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সাথে।
আরও পড়ুন:
ছাত্র-জনতার জোয়ারে সড়কে টিকতে না পেরে বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে গুলি চালায় র্যাব, পুলিশের সদস্যরা। আর তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা। রক্তে রঞ্জিত হয় কালো পিচ। প্রাণ হারান অসংখ্যা ছাত্র-জনতা।
মিরপুরে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ছাত্রলীগেরা আমাকে ধরছে, ধরে মারা শুরু করছে। মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলছে। আমার পিঠে কোপ দিয়েছে। আর এদিকে যুবলীগের নিখিল থেকে শুরু করে তার লাঠিয়াল বাহিনীর সবাই পুরোটা গেরাও দিয়ে রেখেছিল।’
অন্য একজন বলেন, ‘আন্দোলনে আমার তিনটা বুলেট লাগে। হাতে পায়ের অবস্থা তো একেবারেই খারাপ হয়ে যায়।’
২০শে জুলাই আরও উত্তাল হয়ে ওঠে রণাঙ্গন। সীমাহীন ক্ষোভের মুখে মিরপুর ১০ এবং কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে চলে ভাংচুর। আর তার রেশ ধরে পরবর্তীতে রাতে রাতে বাড়ি বাড়ি চলে ছাত্র গ্রেপ্তার, হুমকি-ধামকি। তবুও পিছু হটে না তারা।
মিরপুর ১৩ নম্বর, মিরপুর ১১, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়ার মূল সড়ক থেকে অলিগলি হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার মুক্তাঞ্চল। প্রধান সড়কে বাধার মুখে পড়লে গলিগুলো হয়ে ওঠে তাদের আশ্রয়স্থল। সেখানে বড় সমর্থন আসে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘পুলিশ যখন সামলাতে পারে না তখন আমাদের ওপর হেলিকপ্টার দিয়ে সাউন্ড গ্রেনেড বা গরম পানি এগুলো দেয়া হয়েছিল। অনেক বাসাবাড়ির লোকরা গেট খুলে দিয়ে সাহায্য করছিল।’
আন্দোলনে অংশ নেয়া নারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘স্কুল ছাত্রী থেকে শুরু করে গৃহিণী, কর্মজীবী সব ধরনের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। যে যার জায়গা থেকে যেভাবে পারছে আমাদের সাপোর্ট করে গেছে।’
জুলাইয়ের শেষের দিকে কিছুটা স্থিমিত আগুনের ফুলকি আবারও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আগস্টের শুরুতে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘হাসিনা পতন’ এর এক দফা দাবিতে রাজপথে নামেন ছাত্র-জনতা। পাল্টা আক্রমণে আরও কঠোর হয়ে ওঠে ঘাতকরা।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা এক দফার পক্ষে ৪ তারিখ নামবো। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ পুলিশ বাহিনী এরা ৩ তারিখ রাত থেকেই মিরপুর ১০ নম্বর দখলে নিয়ে রেখেছে।’
৪ আগস্ট এমন এক প্রতিরোধে পুলিশের গুলিতে আহত হন কলেজ পড়ুয়া সামস। সেদিনকার নারকীয় ঘটনার সাক্ষী পা জোড়া এখনও বহন করছে সেই চিহ্ন।
সামস বলেন, ‘আমরা যখন ইট মারতে থাকি তখন তারা একটু একটু করে ব্যাক করা শুরু করে। এখান থেকে আবার গোলাগুলি করা শুরু করে। আমি আর লাস্ট পারসন স্ট্যান্ডিং। যখন গুলি করা শুরু করে, তখন প্রথম গুলিটা লাগে আমার পায়ে।’
‘পরশু নয় কালকেই, লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণায় ৫ আগস্ট লাখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মিরপুর ১০ গোল চত্বর। জনতার ঢল নামে বেগম রোকেয়া সরণি হয়ে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন অভিমুখে। সেই মিছিলেও গুলি চলে। হাজারো শবের সাথে যুক্ত হয় আরও কিছু প্রাণহীন দেহ। তবে ততক্ষণে বিজয় পেয়েছে জনতা।