মনে পড়ে চব্বিশের ৪ আগস্ট রিকশার পাদানিতে ঝুলছিলো শহিদ নাফিসের গুলিবিদ্ধ দেহ? রিকশাওয়ালা তাকে বিজ্ঞান কলেজের দিক থেকে এনে খামারবাড়িতে আল রাজি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে। কিন্তু ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা সেদিন নাফিসকে ঢুকতে দেয়নি হাসপাতালের ভেতরে। নাগালের মধ্যে হাসপাতাল থাকার পরও সেবা না পেয়ে মারা যাওয়ার যন্ত্রণা কেমন তা জানে কেবল একজন শহিদের মা।
নাফিসের মা বলেন, ‘যদি শুনতাম হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার বলেছে সে মারা গেছে তাও আমার শান্তি লাগতো।’
এই গল্প শুধু আল রাজি হাসপাতালের নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে ছোট বড় সব হাসপাতালেই সেবা নিতে সর্বোচ্চ বাধা দিয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। হাসপাতালে হাসপাতালে পুলিশ, র্যাব, এনএসআই, ডিজিএফআই এর তল্লাশিতো ছিলোই।
প্রথম দফায় ১৫ জুলাই ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে ঢুকে আন্দোলনে আহত হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়।
১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই প্রতি মিনিটে তিনটি করে অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করেছিলো ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে গুলিবিদ্ধ এফোঁড় ওফোঁড় হওয়া আহতদের সাধ্যমতো সেবা দিয়েছেন বেশিরভাগ চিকিৎসক। ২৬ জুলাই শেখ হাসিনা আহতদের দেখতে যাবার পর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না দেয়ার সঙ্গে আহতদের জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে দেবার নির্দেশনা দেন। পরিচয়পত্র না থাকায় অনেকের ফিঙ্গার নেয়া শুরু হওয়ায় অনেক রোগী বিনা নোটিশে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। ওই সময় চিকিৎসা প্রদানকারী ৫ জনকে দূরবর্তী জেলায় বদলিও করা হয়েছিল।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেলের একটি বিভাগের প্রধান জানান, আহতদের পাশে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য আতঙ্কিত করে রাখতো।
তিনি বলেন, ‘চাপ না থাকলে আরও বেশি মানুষকে আমরা আরও বেটার সার্ভিস দিতে পারতাম। ছাত্রলীগ, যুবলীগ হাসপাতালের মধ্যেই বিভিন্ন দেশিয় অস্ত্র নিয়ে আহতদের ওপর হামলা করে। পুলিশ এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হাসপাতালে বেডে বেডে এসে রোগীদের নাম পরিচয় নেয়া শুরু করে। তাদের হুমকি দেয়া হয়, তাদের ছবি, ভিডিও, ফিঙ্গারপ্রিন্ট এগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।’
১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর আহতদের ভরসার শীর্ষ কেন্দ্রে পরিণত হয় এএমজেড হাসপাতাল। বিনামূল্যে সেবার খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এএমজেড হাসপাতালের এই পার্কিং এ প্রায় ৫০টি মরদেহ আসে আশপাশের এলাকা থেকে। এদের ২৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী, বাকিরা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। সেবা নির্বিঘ্ন করতে আন্দোলনকারীরা দিনের পর দিন মানব ঢাল হয়ে হাসপাতাল ঘিরে রাখে।
এএমজেড হাসপাতালের ডিজিএম এইচ আর অ্যান্ড অ্যাডমিন রাশিদুল মজিদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের এখানে যখন প্রথম লাশটা আসে তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা ছাত্রদের বিনামূল্যে সেবা দেব।’
এএমজেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন ও ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিনের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ সায়েম বলেন, ‘হাসপাতালে গুলি করা হয়। আমরা চারজন কনসালটেন্ট ৫ দিন একটানা বাসায় না গিয়ে এখানে ছিলাম। আমাদের একজন কলিগ আহত হয়েছিলেন।’
তৎক্ষণাৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সেবাদান থেকে নিবৃত্ত করতে না পারলেও পরবর্তীতে হাসপাতাল ভবন লক্ষ্য করে কয়েক দফা গুলি করা হয়। কর্তৃপক্ষের অন্যতম তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘আমাকে মানবিক অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা মন্ত্রীর রুমে যখন গিয়েছি বিভিন্ন চিকিৎসার বিষয়ে তখন বিভিন্ন নেতা এসে আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। চিকিৎসা করার জন্য তারা আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। আমার রেজিগনেশন লেটার সবসময় পকেটে নিয়েই ঘুরতাম।’
আন্দোলনের শুরু থেকেই সর্বাত্মক নজরদারিতে ছিল ইবনে সিনার সকল শাখা। নানাভাবে হয়রানি করা হয় ইবনে সিনার শংকর ও কল্যাণপুরে অবস্থিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবা কার্যক্রমে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হুমকি ছাড়াও হাসপাতালের সামনে নিয়মিত অবস্থান করতো গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এর মধ্যেও গোপনে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে গেছে ইবনে সিনা হাসপাতাল।
ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালের ডাইরেক্টর অ্যাডমিন মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এডিসি আমাকে বললো পুলিশ কমিশনার আপনাকে তুলে নিয়ে যেতে বলেছে। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে আমাকে ফোন করে বলা হলো আপনি ওদের সেবা দিচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয় আনিস সাহেব এর মূল হোতা। তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসো।’
আহত পুলিশ সদস্যদের সেবা দিলেও আন্দোলনকারীদের সেবা দেয়ার কারণে হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ার থেকে কয়েকজন স্টাফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। একজন স্টাফ বলেন, আমাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলো ধানমন্ডি থানায়। ওখানে তিন দিন রিমান্ডে ছিলাম।