ঠাকুরগাঁয়ে ছয় বছরে গম চাষ অর্ধেকে নেমেছে

ঠাকুরগাঁও
অর্থনীতি , গ্রামীণ কৃষি
কৃষি
0

উর্বর মাটি আর অনুকূল আবহাওয়া হওয়ায় উত্তর জনপদে গম চাষ নিয়ে আছে গর্ব করার মতো ইতিহাস। শুধু তাই নয়,একসময় দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ গম উৎপাদন হতো শুধু উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়েই। কিন্তু বাংলাদেশের রুটির ঝুড়ি খ্যাত ঠাকুরগাঁওয়ে গেল ৬ বছরের গম চাষ অর্ধেকে নেমেছে। যে কারণে গমের চাহিদা পূরণে ব্যয় হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।

চৈত্রের হাত ধরে প্রান্তিকে যখন বসন্ত বিদায়ের নৈসর্গিক আয়োজন, ঠিক তখনই বাসন্তী ফসল ঘরে তোলার বার্তা হয়ে বয়ে যায় মৃদুমন্দ বাতাস।

|undefined

তবে কবি হেলাল হাফিজ যেমন করে বলেছিলেন, ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্বল। ঠিক তেমনি চৈতালী শস্যের মাঠেও আছে মিলন-বিরহের আখ্যান। এই যেমন ঠাকুরগাঁও এর কৃষকের সঙ্গে গমের কথাই ধরা যাক।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে গমের বাৎসরিক গড় চাহিদা ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন। যার বেশিরভাগই চাহিদার যোগান দিতে আমদানি করতে হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। তবে দেশিয় উৎপাদিত ১০ থেকে ১৫ লাখ মেট্রিক টন গমের যে চাহিদার যোগান, তার শীর্ষ জেলা হিসেবে ঠাকুরগাঁয়ের সুনাম আছে কয়েক দশক ধরে। তবে ঠাকুরগাঁওয়ে গেল ৬ বছরে গমের চাষ নেমেছে অর্ধেকে। যে জমিতে একসময় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গমের চাষ হতো সেখানে এখন অন্যান্য ফসলের চাষ হচ্ছে। অবস্থা এমন এ যেন গমের জনপদে গমই হয়েছে সংখ্যালঘু।

|undefined

গমের বড় উৎসে চাষ কমলেও খাদ্যশস্য হিসেবে এর প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে দেশজুড়ে। খাবার উপকরণসহ গমের বহুবিধ ব্যবহার দিন দিন বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়ছে না এর উৎপাদন। কিন্তু কেন?

কৃষকদের একজন বলেন, 'কুমড়া চাষ করলে আমাদের লাভ হলেও গম চাষ করলে লাভ হচ্ছে না কোনো।'

আরেকজন বলেন, 'গতবছর গম বিক্রি করেছি প্রতি বস্তা ৩৫শ' টাকা করে। আর এবার বিক্রি করছি ২৬শ' টাকা বস্তা করে। প্রতি বস্তায় যদি ৯শ' টাকা কম হয় তাহলে কৃষক কীভাবে আবাদ করবে!'

কৃষকদের বক্তব্যের প্রমাণও মেলে পরিসংখ্যানের পাতায়। ২০১৬-১৭ মৌসুমে ঠাকুরগাঁয়ে গম চাষ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে। পরের মৌসুমে কমে দাঁড়ায় ৬১ হাজার হেক্টরে। এর পরের ক'বছরেও ধারাবাহিকভাবে কমেছে আবাদ। সবশেষ ২০২২-২৩ মৌসুমে এই চাষের জমি কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর্। জেলায় ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারেনি স্থানীয় কৃষি বিভাগ।

|undefined

ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'আরও অধিকতর ফলনশীল জাত  এবং এর পাশাপাশি হাইব্রিড ফলনশীল জাতের গম না আসে তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো শীর্ষস্থান আমরা ধরে রাখতে পারবো না। আর কৃষক ভালো দাম না পেলে হয়তো আবাদ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।'

গত কয়েক বছরে গমের দামও বেড়েছে ধাপে ধাপে। যার একটি কারণ আমদানি কমা অন্যটি উৎপাদন। দেশের সবচেয়ে বড় গমের যোগানদাতা রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর পর থেকেই বাড়তে থাকে আটা ও ময়দার দাম। টিসিবির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মার্চে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হত ৩৫ টাকায় আর প্যাকেট আটা কিনতে প্রতি কেজিতে গুনতে হতো ৪০-৪৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে দেশের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা ৫০ টাকা আর প্যাকেট আটার দাম উঠেছে ৬০-৬৫ টাকায়।

|undefined

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলেন, 'আমরা মনে করি স্বাভাবিকভাবে কৃষক যেটাতে লাভবান হবে বেশি সেটাই আবাদ করবে।'

তবে দেশের গম উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ জেলার সাতটি রংপুর বিভাগে হওয়ায় এ অঞ্চলে এখনো গম চাষের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে চান না গম গবেষণা কেন্দ্রের কর্তারা। এ কারণে গম চাষাবাদ বাড়াতে নয়া জাত উদ্ভাবন ও গবেষণার জন্য চান স্থানীয় সুগার মিলের অনাবাদি জমি। তাতে বছরে গড়ে দেশের মাটিতে উৎপাদিত ১২ থেকে ১৫ লাখ টন থেকে গম উৎপাদন কতখানি বাড়বে? প্রশ্ন ছিল গম গবেষণার শীর্ষ কর্মকর্তার ড. গোলাম ফারুকের কাছে।

তিনি বলেন, 'আমাদের গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্নে সুগার মিলের অনাবাদি জমি লিজ নিয়ে গম চাষ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একটা ভালো সম্ভাবনা হতে পারে।'

এদিকে রংপুর অঞ্চলের মাটির উর্বরতা গম চাষের জন্য সহায়ক হওয়ায় প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ আর সচেতনতা বাড়ালে এ অঞ্চলের কৃষকদের কাছে ক্ষতিকারক তামাক চাষের যে আগ্রহ তা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। আর এসব জমিতে গমের আবাদ বাড়লে ফিরে আসবে গম চাষের অতীত জৌলুস আর সাশ্রয় হবে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।

সেজু