৪০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২৫ বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে

চট্টগ্রাম
এখন জনপদে
0

৪০ হাজার মানুষের জন্য বানানো একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পুলিশের দখলে। নেই সরকারি স্কুল, কলেজ। এমনকি সীমানা জটিলতায় গেল ২২ বছরেও হয়নি ভোট। বলছিলাম চট্টগ্রামের উড়ির চর নামের এক ভাগ্য বিড়ম্বিত দ্বীপের কথা।

দেশের দুর্গম দ্বীপ উড়িরচরে তিনতলার জীর্ণ পুরোনো অবকাঠামোটি মূলত একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র হলেও এখানে আসে না কোনো রোগী, নেই কোনো চিকিৎসক কিংবা শয্যা। দ্বীপের ৪০ হাজার মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে বানানো হলেও গত ২৫ বছর এটি ব্যবহৃত হচ্ছে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে।

তবে এখানে করা যায় না কোনো জিডি, নিরাপত্তা চেয়ে আসে না খুব একটা কেউ। নাম কা-ওয়াস্তে কাজ চলা এই ফাঁড়িতে রয়েছেন মাত্র ১২ জন পুলিশ। দেশের অনুন্নত এই অঞ্চলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভবনে ভূতুড়ে পুলিশ ফাঁড়ির কার্যক্রম কীভাবে চলছে তা ভেতরে গিয়ে দেখা গেল।

২০০০ সালে নির্মিত তিনতলার ভবনটি যে পরিবার কল্যাণের একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র তার একমাত্র সাক্ষী দোতলার মলিন ফেস্টুন। এসব কক্ষ মূলত ব্যবহার হচ্ছে ফাঁড়ির হাজতখানা হিসেবে। আর মাঝের পলেস্তারা খসা কক্ষে নামমাত্র চলে পুলিশ ফাঁড়ির দাপ্তরিক কাজ।

ফাঁড়ির এমন দশা নিয়ে কোনো পুলিশ সদস্য কথা বলতে না চাইলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, এই ফাঁড়ি তাদের কোনো কাজে আসে না। থামে না দস্যুতা ও জবরদখলের সংস্কৃতি।

একজন স্থানীয় লোক বলেন, ‘মানুষের একটা মামলা বা জিডি করতে হলে তাকে সন্দ্বীপ আসতে হয়। এটার একদম অকেজো অবস্থা।’

আরেকজন বলেন, ‘চারিদিকে নদী হওয়াতে উপজেলাসহ হাতিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ থেকে আসা সন্ত্রাসীরা উড়িরচরকে অভয়াশ্রম মনে করে।’

দ্বীপে ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু যেন নিত্য ঘটনা। যার সাক্ষী চরের উত্তর প্রান্তের বাসিন্দা কৃষক সাইফুল। ৫ মাস আগে যার ভাগ্যে ঘটেছে নির্মম এক ঘটনা। নৌযানের অভাবে ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিতে না পারায় অকালে হারাতে হয়েছে প্রসূতি স্ত্রীকে।

কৃষক সাইফুল বলেন, ‘নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘাটে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘাটে নিয়ে যাওয়ার পর দেখলাম ঘাটে নৌকা নেই। নৌকার জন্য ফোন দিতে দিতে একসময় নৌকা আসল। আসার পর দেখি সে মারা গেছে।’

রোগ বালাই বা প্রাথমিক চিকিৎসায় এখানকার হাট বাজারের ফার্মেসিই স্থানীয়দের একমাত্র ভরসা। আর জটিল রোগ বা দুর্ঘটনার চিকিৎসায় দুর্গম নদী ও জলপথ পাড়ি দিয়ে তাদের যেতে হয় নোয়াখালী বা সন্দ্বীপের হাসপাতালে।

স্থানীয় একজন ফার্মাসিস্ট বলেন, ‘দ্বীপবাসীর জন্য এই ফার্মেসিগুলোয় হাসপাতাল। জরুরি চিকিৎসা দিতে এখানেই দিতে হয়। আমাদের আয়ত্তের বাইরে হলে পাঠাতে হয়।’

একজন স্থানীয় বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসা খরচ যদি হয় ১০০০ টাকা, যাতায়াত খরচ যায় ৫০০০ টাকা।’

ধান, সবজি, মাছ ও কাঁকড়ায় সমৃদ্ধ এই চরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ, আছে ইন্টারনেট সুবিধাও। অথচ পৌঁছায়নি শিক্ষার আলো। কোনো রকমে চলছে ৪টি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।

একজন তরুণ বলন, ‘এখানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের বসবাস হলেও একটা মাত্র মাধ্যমিক স্কুল, তাও এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি।’

আরেকজন বলেন, ‘এমপিওভুক্ত না থাকায় দাখিল বা মাধ্যমিক লেভেলের যে অতিরিক্ত খরচ বা অন্যান্য সবকিছু মিলিয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারছি না।’

প্রমত্তা মেঘনা আর উত্তাল বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে ১৯৭০ সালে সন্দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণে চরটি জেগে ওঠে। ৮০'র দশকে ভূমিহীন মানুষ এখানে এসে বসতি গড়েন। বর্তমানে এটি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের একটি ইউনিয়ন হলেও নোয়াখালীর সাথে আছে সীমানা জটিলতা। ২২ বছর কোন নির্বাচন না হওয়ায় জনপ্রতিনিধির অভাবে উন্নত হয়নি সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা।

সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা র‌িগ্যান চাকমা বলেন, ‘সীমানা নিয়ে যে সমস্যা আছে সেটা যদি অতি দ্রুত সমাধান হয়ে যায় তাহলে আমরা সেখানে দ্রুত নির্বাচন দিতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘অচিরেই উড়িরচর,ভাসানচর ও স্বর্ণদ্বীপ যে অংশটা,সেটাকে আমরা আবার সন্দ্বীপের মধ্যে নিয়ে আসতে পারবো, আমরা সেই প্রচেষ্টা করছি।’

কৃষিনির্ভর এই চরের জলবায়ু উদ্বাস্তু এসব মানুষ নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়। এ অবস্থায় ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াসহ নাগরিক সুবিধার দাবি স্থানীয়দের।

সেজু