২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ছিল আষাঢ়ের শেষদিন। কিন্তু আকাশের সব মেঘ যেন পুঞ্জিভুত হয়েছিল ছাত্র-জনতার হৃদয়ে। উত্তাল ক্যাম্পাসে হালকা বৃষ্টির সাথে চলেছে মুহূর্মুহু গুলি। তাই এদিন বর্ষণের বদলে, বেশি ঝরেছে ছাত্র-জনতার রক্তধারা।
‘কোটা না মেধা?’ স্লোগানে উত্তরের রাজপথে ছাত্র-জনতার ঢল, উত্তাল নুরলদিনের শহর। কবি সৈয়দ শামসুল হকের ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’— এ হাঁক যেন ধ্বনিত হচ্ছিল রংপুরের পথে পথে। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কেমন ছিল, তা বর্ণনায় যেন প্রত্যক্ষদর্শীরা স্বাক্ষাৎ যমদূতকে দেখেন।
বেলা তখন দ্বি-প্রহর। বেগম রোকেয়ার মূল ফটকের সামনে তখন শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্ততি। ফটক আটকে পুলিশ প্রশাসনের আন্দোলন দমনের কঠোর প্রস্তুতি। সঙ্গে ছাত্রলীগ আর বহিরাগত আওয়ামী কর্মীদের সশস্ত্র অবস্থান।
তাদের সমন্বিত হামলায় যখন ছিন্নভিন্ন ছাত্র-জনতার মিছিল, সেখানেই জুলাই বিপ্লবের ফিনিক্স পাখি হয়ে আবির্ভুত হন আবু সাঈদ। দু’হাত প্রসারিত করে যেন বলতে চাইলেন এভাবে মানুষ মারা চলবে না।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে সম্মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি যখন সহযোদ্ধাদের বাঁধভাঙ্গার সাহস যোগালো, তখনই যেন আগুনে ঘী ঢাললো পুলিশ, আবু সাঈদের বুকে নিশানা করে কয়েকটি বুলেট ছুড়ে।
প্রথম শহিদ আবু সাঈদের খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন গতিপথ তৈরি হয়ে গেলো। সেই আত্মত্যাগেই গণঅভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হয় সারাদেশ।
এদিন কেবল আবু সাঈদকে হত্যা করেই থেমে থাকেনি স্বৈরাচারের প্রশাসন। তার মরদেহ নিয়েও করা হয় নানা নাটকীয়তা। হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে মরদেহ কেড়ে নেয় পুলিশ। হাসপাতালে নিয়ে হিমঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয় নিথর দেহ, হস্তান্তরেও করা হয় গড়িমসি।
লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িবহর এলাকাজুড়ে সৃষ্টি করে আতঙ্ক। পরিবারকে চাপ দেয়া হয় রাতেই দাফনের জন্য। সেদিনের বিষীকাময় পরিস্থিতি এখনও দগদগে প্রত্যক্ষদর্শী বৈষম্যবিরোধী শিক্ষকদের চোখে-মুখে।
আবু সাঈদের মৃত্যুর মাধ্যমে জুলাইয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিপ্লবে রূপ দেয়ার নেপথ্যে, ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ এখন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
১৬ জুলাই আবু সাঈদের সাহস ও বীরত্ব যেভাবে হয়ে উঠেছিল মিছিলের মোহনা, তার বছর পূর্তীতে মানুষের প্রত্যাশা, সেভাবেই সকল বৈষম্য ও নিপিড়নের বিরুদ্ধে বাংলার তারুণ্য উচ্চারণ করবে— ‘বন্ধু নামো পথে, কথা হবে যেতে যেতে।’