চাঁদপুর জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে বাজার করতে দেখা যায় শহরের ওয়ারলেস বাজারে। তার সামনেই ব্যবহার হচ্ছিল পলিথিন ব্যাগ। ভোক্তা হিসেবে তিনি নিজেও বাধ্য হয়েছেন পলিথিন ব্যবহার করতে। কারও কোনো দায়বোধ নেই। শহরজুড়ে দেখা মেলে একই চিত্র।
বিক্রেতারা জানান, দোকানে পলিথিন পাওয়া যায় বলেই তারা সেগুলো ব্যবহার করছেন। বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে পারতেন বলেও জানান তারা।
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা যখন বাজার করতে যাই তখন একরকম আর যখন আইন প্রয়োগ করতে যাই, তখনকার বিষয়টি অন্যরকম।’ অথচ গেলো বছরের সেপ্টেম্বরে, সরকারের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা পলিথিন বন্ধে কঠোর হবার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
চাঁদপুর জেলা ঘিরে আছে তিন নদী-পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া। শহরের মাঝে দিয়ে বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী। ব্যবহৃত প্লাস্টিকসহ রোজকার বর্জ্যের বড় একটি অংশ ফেলা হচ্ছে এ নদীতে, যা গিয়ে পড়ছে মেঘনায়। শহরে প্রতিদিন প্রায় ১৫ থেকে ১৬ টন বর্জ্য তৈরি হয়, যার ২৫ ভাগই প্লাস্টিক ও পলিথিন।
চাঁদপুর পৌরসভার প্রশাসক মো. গোলাম জাকারিয়া বলেন, ‘বাসা-বাড়ি থেকে সংগৃহীত পলিথিন নদীতে যায় না। যেগুলো ট্রেনে বা বিভিন্নভাবে সরাসরি নদীতে ফেলা হয়, সেগুলোই নদীতে যায় বলে আমরা আশঙ্কা করছি।’
মেঘনায় দীর্ঘদিন ধরে ইলিশ মাছ ধরেন করেন মোহম্মদ হাবিব। দুই দশকের অভিজ্ঞতায় নানা পরিবর্তনের সাক্ষী তিনি। বিশেষ করে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে নদী ও মৎস্য সম্পদ বিপন্ন বলে উদ্বিগ্ন এ জেলে।
মো. হাবিব বলেন, ‘আগে মাছ ছিল, এখন নদীতে মাছ নেই। পলিথিনের জন্য এখন জালে মাছ ধরা পড়ে না। খাল-বিল, নদী-নালা থেকে এ পলিথিন আসছে।’
চলতি বছর মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে এমন চারটি জেলার ইলিশ নিয়ে গবেষণা করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। গবেষকরা ইলিশের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পেয়েছেন। একই ফল পেয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকও।
আরও পড়ুন:
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মূলত ইলিশের অন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকটা পেয়েছি। যকৃৎ বা শরীরে আমরা এটি দেখিনি। তবে শরীরে এটা ছড়িয়ে না পড়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
পলিথিন ব্যাগ, মোড়ক, বোতল, টেক্সটাইল ফাইবার, এমনকি গাড়ির টায়ার থেকেও প্লাস্টিক জমে নদীতে। পানি আর সূর্যের তাপে ভেঙে হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা, যা খাবার হিসেবে খেয়ে ফেলে মাছ।
ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘প্লাস্টিক দূষণ বা যেকোনো হেভি মেটাল দূষণ যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে তাহলে এটা ইলিশের জীবনচক্র, প্রজনন এমনকি সামগ্রিক উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।’
২০২২ সালে, নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক প্রথমবার মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের মতে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মানব শরীরে প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, যা হতে পারে ক্যান্সারের কারণ।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘প্লাস্টিক কিন্তু মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এটি কেবল মানুষের হজমে সমস্যা করবে তা নয়, প্রদাহও করবে। এক পর্যায়ে গিয়ে এটা ক্যান্সারেরও সৃষ্টি করতে পারে।’
দেশে উৎপাদিত ইলিশের একটি বড় অংশ আসে চাঁদপুর থেকে। মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গেলো অর্থবছরে এ জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার টন ইলিশ মাছ শিকার করা হয়েছে।
নিষেধ তো নিষেধই। চটকদার ঘোষণা আর জনগণের টাকায় কিছু পোস্টার ছাপিয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, তা আগেও দেখা গেছে। বন্ধ করতে হলে, হতে হবে কঠোর—নিশ্চিত করতে হবে বিকল্প ব্যবস্থা। তা না হলে প্লাস্টিক আজ নদীতে-মাছের পেটে, কাল হয়তো পাওয়া যাবে মানুষের শরীররেই।