অনাহারে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে গাজা উপত্যকার অবুঝ শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ। প্রতিদিনই প্রাণহানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পারা অসহায় ফিলিস্তিনি। যার মধ্যে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।
খাদ্য সংকটে এমন করুণ পরিস্থিতির মধ্যেও সীমান্ত দিয়ে ত্রাণ বোঝাই ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরাইল। আগ্রাসনের পাশাপাশি নেতানিয়াহু প্রশাসন অবরোধ তুলে না নেয়ায়; গাজায় দুর্ভিক্ষের হানা আর ঠেকানো গেল না।
প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা ৫ লাখ ১৪ হাজার ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষের শিকার বলে প্রথমবারের মতো তথ্য তুলে ধরলো জাতিসংঘ সমর্থিত সংস্থা-আইপিসি। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা গাজা গভর্নরেট এলাকার। আগামী মাসে পুরো উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পরবে বলে সতর্কও করেছে সংস্থাটি।
আইপিসি'র প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন বিশ্বের পঞ্চম অঞ্চল হিসেবে গাজা তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফপি।
আরও পড়ুন:
ডব্লিউএফপিয়ের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক জিন-মার্টিন বাউয়ার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম দুর্ভিক্ষের খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। আইপিসি'র তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে গাজা পঞ্চম অঞ্চল; যেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। মে মাস থেকে গাজায় অপুষ্টি তিনগুণ বেড়েছে। এবার দুর্ভিক্ষের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’
আইপিসির দেয়া তথ্যে প্রমাণও পেয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। গাজা সিটিতে সরেজমিনে দেখা গেছে, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে দোকানপাট খালি পড়ে আছে। নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হলেও, অর্থের বিনিময়েও মিলছে না পণ্য। খাদ্যতো বটেই, সুপেয় পানিরও তীব্র সংকট।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘শেষ পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, লাগেজ দিয়ে অর্থ নিয়ে গেলেও ময়দা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যাবে না। বেচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের উপায় নেই। কোনও পণ্যেরই সরবরাহ নেই।’
আরেকজন বলেন, ‘বিভিন্ন সহায়তা সংস্থাও বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। সংস্থাগুলো আমাদের আগে আটা, চাল, ডাল, চিনি দিতো কিন্তু এখন, কিছুই নেই। আমরা কীভাবে বেঁচে থাকবো জানিনা।’
এমন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির জন্য ইসরাইলকেই দায়ী করলো জাতিসংঘ। এক্স পোস্টে একে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, নৈতিক অবক্ষয় এবং মানবতার ব্যর্থতা বলে অভিহিতও করেছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া অনাহারে গাজায় মৃত্যুর ঘটনা যুদ্ধাপরাধের শামিল বলে, তেল আবিবকে সতর্কও করেছে সংস্থাটির অন্যান্য কর্মকর্তারা। ইসরাইল অবরোধ তুলে নিলে গাজায় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধযোগ্য বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের ওএইচসিএইচআরের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স বলেন, ‘ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাও যুদ্ধাপরাধ। এভাবে অনাহারে রেখে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলে তা যুদ্ধাপরাধের সমান হতে পারে। গাজা গভর্নরেটে দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটাতে এবং গাজা উপত্যকায় আরও প্রাণহানি রোধ করতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ বিভাগের কোঅর্ডিনেটর টম ফ্লেচার বলেন, ‘এটি এমন একটি দুর্ভিক্ষ যা সরবরাহের অনুমতি পেলেই আমরা প্রতিরোধ করতে পারতাম। তবুও, ইসরাইলি বাধায় সীমান্তে খাদ্যের স্তূপ জমা হয়। যার কারণে একটি উর্বর ভূমি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।’
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুধু জুলাই মাসেই গাজার ১২ হাজার এরও বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। মাসের ভিত্তিতে যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যা। বছরের শুরু থেকে হিসেব করলে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ৬ গুণ বেড়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত অনাহার অপুষ্টিতে প্রাণহানি ২০০ ছাড়িয়েছে।
এসব চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আইপিসির দেয়া দুর্ভিক্ষের খবরকে মিথ্যা এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে উড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইল। আইপিসি হামাসের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে জরিপ চালিয়েছে বলে দাবি করছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।