গেল চার দশক ধরে নীতিগত অবস্থানে দৃঢ়তা দেখানোর পাশাপাশি কৌশলগত কূটনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ইরানের অভ্যন্তরে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক রাজনীতিতে গালফ উপসাগরীয় সুন্নি রাষ্ট্রগুলোকে টেক্কা দেয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে অবিসংবাদী এক নেতায় পরিণত হয়েছেন ৮৬ বছর বয়সি খামেনি।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটির সুরক্ষার প্রশ্নে ইরাকের সঙ্গে ১৯৮৮ সালে হওয়া যুদ্ধবিরতির চুক্তির পুনরাবৃত্তি বা ২০১৫ সালে ৬ শক্তিধর দেশের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে রাজি হতে দেখা গেছে ক্যারিশমাটিক এই নেতাকে। পূর্বসূরী খোমেনীর মতো ধর্মীয় ক্রেডেন্সিয়াল না থাকলেও ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোতে ইসলামিক গার্ড কর্পসকে ব্যবহার করছেন কৌশলের সঙ্গে।
গেল শুক্রবার ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পর থেকে ইসরাইলের সঙ্গে পুরোদমে সংঘাতে জড়িয়েছে তেহরান। সংঘাত শুরুর পরপর পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে গুপ্ত হত্যার পরিকল্পনা করছে তেল আবিব। এবং এতে সমর্থন নেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের।
এবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুও বলছেন, একমাত্র খামেনিকে সরাতে পারলে শান্ত হবে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্য। আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পরিণতি হতে পারে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মতো- এমন হুঁশিয়ারি ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর। প্রশ্ন উঠছে তাহলে কী খামেনি শাসনের পতন ঘটলে থেমে যাবে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ট্রাম্প প্রশাসনও কী এই একই সমাধান চায় কী না!
ইতিহাস বলছে, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, পশ্চিমাদের চোখে যিনি ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক, ২০১১ সালে তাকে হত্যার সময়ও একই বয়ান প্রচার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। এর ৮ বছর আগে ২০০৩ সালে, সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার পর মার্কিন প্রশাসকরা ঘোষণা দেন, নিষ্ঠুর শাসকের হাত থেকে রক্ষা পেল ইরাকের নিপীড়িত মানুষ। যদিও গেল এক যুগ ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সঙ্গে লড়ছে লিবিয়া আর বিবিসি বলছে, ৫১ শতাংশ ইরাকি বিশ্বাস করেন ২০০৩ এ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের পর থেকে সে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা বলছেন, খামেনিকে হত্যা করলে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক যে চাপ আসবে তা সামলাতে পারবেন না নেতানিয়াহু। কিংবা খামেনি প্রশাসনের পতন হলেই মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না তারা। কারণ জাতিগত মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সমঝোতা করবে না ইরান।
কলামিস্ট ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক গিডিয়ন লেভি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইসরাইল বা ইরান কারোরই যুদ্ধ থামানোর সক্ষমতা নেই। তাদের বিদেশি মিত্রের সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু তাদের পিছু হটতে হয় বা পরাজয় হয় এমন কোনো চুক্তি মেনে নেবে না ইরান। তাদের জন্য জাতীয় গৌরব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
এদিকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইরান-ইসরাইল সংঘাতে খুব একটা তৎপরতা নেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের। অথচ ক্ষমতা গ্রহণের পর সব যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বহুবার। এখনও ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত থামার কোনো আলামত পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো লেবানন-ইয়েমেন-ফিলিস্তিনের পর অক্ষশক্তির মূলে থাকা ইরানের সঙ্গে সংঘাত বেধে গেছে ইসরাইলের। বিশ্লেষকদের দাবি প্রতিপক্ষকে চাপ দিয়ে সংঘাত বন্ধের যে কূটনীতিতে আস্থা রেখেছেন ট্রাম্প- তা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।