ফিরে দেখা ১৭ জুলাই: নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে

দেশে এখন
0

আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নারকীয় হামলার ঘটনায় ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা। ১৬ জুলাই সেই ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা যায় রাজপথে, শহিদ হন ৬ জন। এদিন ছাত্রলীগমুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরদিন ঢাবিতে গায়েবানা জানাজা ও প্রতীকী কফিন মিছিল শুরু করলে ফের গুলি করে পুলিশ। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী, অংশ নেয় সর্বসাধারণ।

চব্বিশের ১৭ জুলাই সকালের চিত্র। ক্যাম্পাস ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে হল ছাড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। কারণ রাতে ঘটে গেছে বিস্ময়কর ঘটনা। বিগত ১৫ বছরে দেশের একক আধিপত্যবাদী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছে। ১৫ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

জসিম উদ্দিন হলের শিক্ষার্থী আশিক খান বলেন, ‘আমাদের সবার মাঝেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিলো। আমাদের ভেতরে কাজ করছিলো যেকোনো ভাবে এ ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে এবং ছাত্রলীগকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হল থেকে বের করবো।’

১৬ জুলাই প্রতিবাদ মিছিল থেকে শহিদ হন ৬ জন। এদিন রাতে দখলমুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল। অতঃপর শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতীকী কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার সিদ্ধান্ত নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা।

ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘সন্ধ্যায় মাহফুজ ভাই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে আপনারা কি চিন্তা করেছেন? আমি আর সাদিক ভাই তখন পরামর্শ করছিলাম। সাদিক ভাই তখন ফোনে মাঝে মাঝে কথা বলছিলো। তখন আমরা মাহফুজ ভাইকে বলি কর্মসূচীটা এরকম হতে পারে যে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা। উনারাও নিজেদের মাঝে আলোচনা করলেন। এটা সাথে সাথে এপ্রুভ হলো। রাতে আবার মাহফুজ ভাই ফোন দিয়ে বললো ভাই কর্মসূচী ঘোষণা হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে।’

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে সেদিন কড়া পাহারায় পুলিশ ও র‍্যাবের বিপুল সদস্য। কফিন মিছিলে অংশ নিতে দুপুরে ক্যাম্পাসে আসেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির তৎকালীন আহ্বায়ক আখতার হোসেন। এতদিন আন্দোলনের নেপথ্যে থাকলেও সেদিন প্রথমবার প্রকাশ্যে আসলে তাকে টার্গেট করে পুলিশ।

পুলিশের পরপর কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। গ্রেফতার হন আখতার ও তার সঙ্গীরা।

জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীরা আমাদের অধিকারের কথা ক্যাম্পাসে বলবো আর পুলিশ এসে আমাদের আটক করবে এটা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না। আমি এ বিষয়টা নিয়ে পুলিশের সাথে কথা বলছিলাম। কিন্তু তারা কয়েকজন জোড় করে আমাকে ধাক্কা দিতে শুরু করে। তখন আমরা বলেছিলাম আমাদের লাশ ক্যাম্পাস থেকে যাবে কিন্তু আমরা যাব না।’

পুলিশি বাধায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি পণ্ড হলে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে।

তবে ক্যাম্পাসে কফিন প্রবেশ করা সহজ ছিল না। প্রতিটি প্রবেশপথে তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি।

ঢাবি ছাত্রশিবিরের তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের সম্পাদক মো. জায়েদুল হক বলেন, ‘তখন ভাই আমাদের ওপর দিয়ে কিছু সাদা কাপড় দিয়ে দেন। যাতে কফিন প্রবেশ করতে না পারলে কোন ইট বা লাঠির ওপর সাদা কাপড় রেখে কফিন সাজিয়ে কর্মসূচী করা যায়। তিনি বলেন, নীলক্ষেতের দিকে তোমাদের একটা মিছিল পাঠাও। তখন আব্দুল কাদিরসহ আমরা একটা মিছিল নিয়ে ওদিকে যাই। নীলক্ষেতে মিছিলে পুলিশ বাঁধা দিতে আসলে সে সুযোগে ভাইরা কফিন ভেতরে নিয়ে আসে।’

শাহবাগ থানা পশ্চিমের আমির অ্যাডভোকেট শাহ মাহফুজ বলেন, ‘আমরা যখন তাদের কাপড় দিলাম কিন্তু কফিন বানানোর মতো কাঠ বা লাঠি পাচ্ছে না তখন বললো অন্তত একটা কফিন হলেও দেন। তাদের দরকার ছিলো ৭টা কফিন। ততক্ষণে পুলিশের ব্যারিকেড পার হয়ে এম্বুলেন্স চলে এসেছে৷ এম্বুলেন্সের ভেতরেই ছিলো কফিন।’

বিকেল চারটার আগে ভিসি চত্বরের সামনে কফিন পৌঁছায়। শুরু হয় গায়েবানা জানাজা। জানাজা শেষে বিকেল চারটা ১০ মিনিটে কফিন মিছিল শুরু হয়। পুলিশের ব্যারিকেড অতিক্রম করে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যায় সামনে।

রোকেয়া হলের সামনে এগিয়ে গেলে মিছিলে সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল।

এসব ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রশাসন।

ইএ