জুলাই ব্ল্যাকআউটের দিনলিপি: নিরাপত্তার ভয়ে সিম বদলে আন্দোলন চালানোর ইতিহাস

ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে থাকায় থমকে ছিল অনেক অনলাইন প্রতিষ্ঠান
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
3

গত বছরের এই দিনে প্রথমবারের মতো স্বৈরাচারের হাতে পৃথিবী থেকে দেশ আলাদা হয়ে পড়ে ইন্টারনেট জগৎ থেকে, ব্ল্যাক আউটের মুখে পরে বাংলাদেশ। নাটক সাজিয়ে বলা হয়, ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি, বন্ধ হয়ে গেছে। কী ঘটেছিল সেদিন?

‘ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, বন্ধ হয়ে গেছে।’ গত বছরের ২৭ জুলাই এমন উদ্ভট বক্তব্য দেয় জুনাইদ আহমেদ পলক।

জুলাই আন্দোলন দমাতে মিথ্যাচার চালিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমন-নিপীড়ন আরও নির্বিঘ্নে চালাতে, আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে এমন মিথ্যা ও প্রতারণার জাল বুনে স্বৈরাচার। সেসময় সরকার শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি, পুরো দেশকে বিচ্ছিন্ন করে ইন্টারনেট থেকে।

সমন্বয়কদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা যখনই ফোনের মাধ্যমে কাউকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম, তখন ফোন ঝিরঝির করতো। তখন আমরা বুঝতে পারতাম যে আসলে আমাদের ফোনটা ট্র্যাক করা হচ্ছে। বাকের ভাই, আসিফ ভাই, আমার বন্ধু রিফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ফোনেই যোগাযোগ করছিলাম। যেহেতু ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করে দেয়া হয়েছিল, আমাদের ম্যাসভাবে যোগাযোগ করার কোনো অপশন ছিল না। আমরা গুটিকয়েক মানুষের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছিলাম।’

অন্য একজন বলেন, ‘আমাদের একটা গ্রুপ করা হয়েছিল। ওই গ্রুপগুলোতে প্রতিজনের প্রতিনিধি ছিল। আমরা এক-দুইজনকে বললেই ওরা সবাইকে গ্যাদারিং করে নিয়ে আসতো।’

ইন্টারনেট বন্ধের এই নাটক শুরু ১৭ জুলাই। রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা ও আশপাশে অন্তত পাঁচ থেকে আটটি টাওয়ারের সাইট বন্ধ করতে দিতে মোবাইল অপারেটরগুলোকে চাপ দেয় কর্তৃত্ববাদী সরকার। অপারেটরগুলো বাধ্য হয়ে তা বন্ধ করলেও দূর থেকে টাওয়ারের নেটওয়ার্ক মিলছিল। এরপর আরও বেশি সাইট বন্ধ করার নির্দেশ দেয় সরকার। সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান যেমন এসব অপারেটরদের সেবা বন্ধের ব্যাপারে চাপ দেয়, তেমনি নির্দেশনা আসে বিটিআরসি থেকেও।

তাতেও আন্দোলন দমাতে না পেরে একপর্যায়ে রাজধানীসহ সারাদেশের ফোরজি ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। কী পরিস্থিতিতে সেটি করতে বাধ্য হয় টেলিকম অপারেটররা?

গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ বলেন, ‘ইন্টারনেটকে কিন্তু এখন একটা মৌলিক অধিকারই বলা চলে। হঠাৎ করে যদি এই অধিকারটা তুলে নেয়া হয় তাহলে লাইফ স্টাইলের বেসিক চাহিদার ওপর চরম ইমপ্যাক্ট আসে। সবচেয়ে বড় ইমপ্যাক্ট আসে কিন্তু ইউজারদের ওপর। যারা আমরা এই সার্ভিসগুলো প্রোভাইড করছি তাদের ওপর অবশ্যই চাপ আসে।’

আরও পড়ুন:

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি কর্মকর্তা সাহেদ আলম বলেন, ‘সরকার যদি অনুমতি দেয় ইন্টারনেট চালু হবে, সরকার যদি বলে ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে তাহলে বন্ধ থাকবে। এ কারণে সেসময় একটা বড় ধরনের চাপ আমাদের ওপর ছিল।’

যদিও তখনও পাওয়া যাচ্ছিলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। আন্দোলনকারীরা তা ব্যবহার করেই ফ্যাসিস্ট সরকারের চালানো নির্মম হত্যাকাণ্ডের ছবি ও তথ্য তুলে ধরছিলেন নেট দুনিয়ায়। যা সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারকে আরও চাপে ফেলে দেয়। তখন এই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধেরও অজুহাত খুঁজছিল কর্তৃত্ববাদী সরকার। মোবাইল ইন্টারনেট না থাকায় চাপ বাড়ে ব্রডব্যান্ড সেবায়। এরপরই ১৮ জুলাই।

১৮ জুলাই বিকেল নাগাদ মহাখালির খাজা টাওয়ারের পাশের দুর্যোগ ভবনে আগুন লাগে। এতে ভবনের পাশে থাকা কিছু তার পুড়ে যায়। এটা পুঁজি করেই বলা হয় আগুনের কারণেই ব্রডব্যান্ড সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ মহাখালির এই খাজা টাওয়ারের তখন কোনো ক্ষতি-ই হয়নি।

মহাখালীর খাজা টাওয়ারকে পুঁজি করে সারাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, আইএসপি অপারেটরদেরকে নির্দেশনা দিয়েই বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট। কিন্তু না, দুটি সাবমেরিন গেটওয়ে ও আমদানি করা ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিস্ট সরকার এতে নেট দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে যায় বাংলাদেশ।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে ইন্টারনেট আমদানি বা ইন্টারনেট আসার যতগুলো গেটওয়ে আছে বা যতগুলো সোর্স আসে, এই ছয় বা সাতটা সোর্সই তখন সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। খাজা টাওয়ারের অগ্নি সংযোগ বা যে দুর্ঘটনা হয়েছিল তার সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারনেটের শাটডাউনের কোনো সংযোগ নেই। এটা সম্পূর্ণ পলকের নাটক ছিল।’

আরো পড়ুন:

ইন্টারনেট বন্ধের মধ্যেই গুম করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদ অন্যতম। মোবাইল ইন্টারনেট যখন বন্ধ, চালু রাখা হয় ২জি সেবা। এতে ভয়েস কলেই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছিলেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে একের পর এক সিম পরিবর্তন করতে হয়েছিল তাদের।

আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তখন নরমাল মোবাইল ফেন আমরা ব্যবহার করেছি। কিন্তু একটা ফোন এবং একটা সিম একবারের বেশি আমরা ব্যবহার করিনি।’

অন্য একজন বলেন, যোগাযোগের কোনো মাধ্যমে ছিল না, যে গ্রুপগুলো ছিল সেগুলোতেও অ্যাক্টিভ হতে পারছিলাম না তখন মোবাইলে কল দিয়ে, ম্যাসেজের মাধ্যমে আমরা সবাই একজায়গায় জড়ো হই। তারপর আমরা সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি।’

সরকার ইচ্ছে করলেই যে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে সে ব্যাপারে নীতি নির্ধারণে কতটা পরিবর্তন এলো? নাকি আগামী দিনেও সে সুযোগ থাকছে? প্রশ্ন ছিল অপারেটরগুলোর কাছে।

সাহেদ আলম বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ করার নীতি আছে। কিন্তু সেটা একটা প্রসেসের মাধ্যমে যেতে হয়। বেশ কয়েকটি স্টেপে সেই অ্যাকশনটা আসে। আবার কিছু কিছু দেশে নীতি থাকলেও কিন্তু সেটা করা হয় না। এটা আসলে সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সবসময়।’

মোবাইল ইন্টারনেট ১৩দিন আর ব্রডব্যান্ড আট দিন বন্ধের ফলে দেশে ই-কমার্স, এফ কমার্স ভিত্তিক ব্যবসায় যেমন ধস নামে, তেমনি আমদানি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ মুখ থুবড়ে পরে। এক সমীক্ষায় বলছে, এতে ক্ষতি প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।

এসএস