ঈদ-উল-আজহার ছুটি শেষে চব্বিশের ১ জুলাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন। ওই দিনই কোটা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ২ জুলাই বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে তারা। এসময় বিভিন্ন শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ৪ জুলাই ছাত্রলীগ এ আন্দোলনে প্রথম হামলা চালায়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সারাদেশে এ আন্দোলনটা একটা গোছানো আন্দোলন ছিলো। এ আন্দোলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো এবং বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে উঠেছিলো এ প্রাণের দাবি আদায়ের জন্য।’
কেন্দ্র থেকে আসা নির্দেশনা অনুসারে চলতে থেকে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি। ১১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে চাইলে তাতে বাধা দেয় পুলিশ। ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা, পুলিশ হটিয়ে দখল করেন রাজপথ।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের একটা চাপ ছিলো। বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কিন্তু আমাদেরটা খোলা ছিলো। ফলে আমাদের প্রস্তুতি বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই নেয়া লেগেছে।’
১৭ জুলাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা হয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল ত্যাগের নির্দেশনা দিলেও শিক্ষার্থীরা হল ছাড়েননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনেই করা হয় গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ভূমিকা বলেন, ‘যখন টিয়ারশেল মারা হয় তখন আগুন জ্বালিয়ে তাদের শ্বাসকষ্ট দূর করার যে চেষ্টা তার পুরোটাই করেছে নারী শিক্ষার্থীরা।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৮ জুলাই। কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি জড়ো হয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে বের হতে চাইলে তাদের বাঁধা দেয়া হয়। একপর্যায়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটে আহত হয় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ পিছু হটে খয়রাবাদ সেতুতে আটকে পরে। তারা শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চাইলে বরিশালে বিজয়ের সূচনা হয়।
বরিশাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক রাকিব আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে দিচ্ছে না। এক পর্যায়ে আমরা বলি যে আমার রাস্তা আটকাবো না, মূল ফটকের সামনেই আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবো। কিন্তু তারা আমাদের ওপর জুলুম করা শুরু করে। তারা বলে আপনারা গেটের বাইরে আসতে পারবেন না। বাইরে আসলেই আমার আপনাদের গুলি করবো।’
৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে যাবার পথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় ৩ সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়। আটক হয় বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী। সংঘর্ষে নগরীর ফজলুল হক এভেনিউ ও সদর রোড রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। পথচারীসহ অনেকে আহত হন।
জুলাই আন্দোলনের সংগঠক মোকাব্বেল শেখ বলেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের হাত ভেঙে যায়। আজন আপু খুবই গুরুতর আহত হয়। এছাড়া চারজন লাঠিচার্জে আহত হয়। আরও একাধিক আহত হয়। আমাদের মিছিলটা ধীরে ধীরে সদরের ভেতরে ঢুকতে থাকে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনতার একদফা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হলে বরিশাল বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মিশে যায় জনস্রোতে। বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ-চৌমাথা এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলনে যুক্ত থাকেন শিক্ষার্থীরা।
ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের সংগঠক মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করে, টিয়ারশেল মেরেছে। কিন্তু আমরা এত বেশি ছিলাম এবং আমাদের তারুণ্যের যে স্পৃহা এর সামনে তারা টিকতে পারেনি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিএম কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, বরিশাল কলেজ, শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, সরকারি পলিটেকনিক কলেজসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও ছিলো চোখে পরার মত।
ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক মো. ইফতিকার রহমান বলেন, ‘৫ তারিখ হাসিনা পতনের পর তাদের খুঁজতে যাওয়া হলো কিন্তু ছাত্রজনতা তাদের আর খুঁজে পেলো না। কারণ ৪ তারিখেই এমন প্রতিরোধ দেখে পুলিশ বাহিনী পালিয়ে গেছে।’
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তীব্র হতে শুরু করে তখন তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন রাজপথে আরও মারমুখী হয়। শিক্ষার্থীরা মাঠ থেকে সরে না যাওয়ায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ মাঠে নামে আন্দোলন দমনে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ ঢাকা–বরিশাল মহাসড়কের সি এন্ড বি রোড এলাকা দখলে নেয়। সড়কের উপর আগুন জ্বালিয়ে আন্দোলন চালাতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবরে মুহূর্তেই পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট। শুরু হয় বিজয়ের উল্লাস।