বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের উপরে পৈশাচিক নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দেয় এ জুলাই। গুম-খুন আর নিখোঁজের বেদনায় ভরে উঠেছিল নিউজ ফিড। তাই ইন্টারনেট বন্ধ করে সত্যকে চাপা দেয়ার চেষ্টাও চলে।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বন্ধুর বাড়ি থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় নাহিদ ইসলামকে। তাকে খুঁজতেই ২০ তারিখ দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে আসে নাহিদ ইসলামের মা ও বাবা। চোখে আতঙ্ক ও মুখে আকুতি নিয়ে বলেছিলেন, ফেরত চান সন্তানকে।
নাহিদের বাবা জানান, রাত আড়াইটার সময় ডিবি পরিচয়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন লোক নাহিদকে সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য চাপ দিয়েছে। তখন সে (নাহিদ) বলেছে, আন্দোলনে থাকা তার বন্ধু-বান্ধবদের হত্যার পর আর সংলাপ হতে পারে না।
ডিবি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, নাহিদ ইসলামের কোন খোঁজ তাদের কাছে নেই।
সেসময় সমন্বয়ক ও সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা সাংবাদিকদের জানান, সারজিস ও হাসনাত। বলেন, সরকারের সঙ্গে কোনও সংলাপ হয়নি।
সারজিস বলেছিলেন, ‘আমরা আজ খুঁজতে চেষ্টা করবো তাকে, যতক্ষণ খোঁজা যায়। কিন্তু সময় শেষ হলে আবার কাল থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-ই হবে।’
হাসনাত বলেছিলেন, ‘আমরা কখনোই শহিদদের রক্ত মাড়িয়ে আলোচনায় যেতে পারি না।’
আরেকটু পেছনে ফিরে গেলে উঠে আসে, ১৭ জুলাই যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী শহর জুড়ে খুঁজছিল নাহিদ ইসলামকে তখন তিনি আশ্রয় নেন ধানমন্ডির এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। তবে সেখানেও থাকা যায়নি বেশি সময়। সন্ধার পর ব্যাগ, ফোন ও জুতা রেখে খালি পায়ে হেটে রাত কাটান এক মসজিদে।
আশ্রয়দাতা সেই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বড় ভাই আমাকে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলে আপনার ওখানে একটু থাকতে চাচ্ছে, আমি পাঠাচ্ছি। আমি পাঠাতে বললাম। তারপর ও আসলো। তখন তো ও বাচ্চা ছেলে, চেহারার অবস্থা খুবই বিধ্বস্ত। আমি খাওয়ার পর যখন রুমে গেছি, দেখি ও মোবাইল ওপেন করেছে। আমি তাকে বলেছিলাম, মোবাইলটা ওপেন করা ঠিক হয়নাই।’
ধারণা করা হয়, নাহিদের ফোন নম্বর ট্র্যাক করে ১৯ তারিখ খিলগাঁওয়ের এক বাড়ি থেকে তুলে নেয়া হয় নাহিদকে। একই দিন ধানমন্ডির যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল নাহিদ, সে বাড়ির ঘেরাও করে তুলে নেওয়া হয় আশ্রয়দাতাকেও। সেই নির্যাতন যেন এখনো চোখে ভাসে সেই ব্যবসায়ীর।
সেই ব্যবসায়ী বলেন, ‘দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করতে দেখে আমি দরজা খুলে দিয়েছি। সিসি ক্যামেরাগুলো তারা নিয়ে গেছে। দাড়োয়ানদেরও বেঁধে নিয়ে গেছে।’
২১ জুলাই সকালে পূর্বাচলে অচেতন অবস্থায় নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায়। তার শরীরে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন দেখে শিউড়ে উঠেছিল দেশবাসী।
নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘আমাকে আন্দোলনের ব্যাপারে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা জানতে চায় আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য। আমরা এ আন্দোলন কেন বন্ধ করছি না তাও জানতে চায়। পরবর্তীতে আমার ওপর অনেক মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে আমি সেন্সলেস হয়ে যাই।’
সেই গুম-হত্যা আর নির্যাতনের মসনদ ভেঙে যায় ৩৬ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সেদিন নাহিদের মুখেই উচ্চারিত হয়েছিল নতুন বাংলাদেশের কথা।