গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ৮০ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী; স্বীকৃতি চায় আলেম সমাজ

গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

‘শহিদি তামান্না’ নিয়েই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসেন তারা। কয়েকদিনের মরণপণ সংগ্রামে মাদ্রাসা থেকেই শহিদ হন প্রায় ৮০ জন। তবে আলেম সমাজের অভিযোগ, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানসহ দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও যথাযথ স্বীকৃতি পাননি তারা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাশাপাশি নৈতিক পরিবর্তনের তাগিদ তাদের।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ ছাত্র-জনতার সঙ্গে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে একদল শুভ্র সাদা পোশাকের শিশুকিশোররাও। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও বুক পেতে দেয় বন্দুকের নলের সামনে।

গত বছরের ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণার পর দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল থেকে রাজধানীর প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ি কার্যত বন্ধ করে দেয়া স্থানীরা ছাত্র-জনতা।

১৯ জুলাই জুমার নামাজ চলাকালেই হামলা হয় যাত্রাবাড়ি বড় মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ায়। এরপর জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন।

জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ইউসুফ আহমাদ বলেন, ‘যখন ওরা ১৯ তারিখ আমাদের আক্রমণ করলো তখন আমরা একযোগে মাদ্রাসা গেট দিয়ে বের হয়ে এটা প্রতিহত করি। তারাও একটু বিশ্রাম নেয়। তারা সকাল থেকে শুরু করতো, সকাল ৮টা বা ৯টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত আমাদের ওপর এই আক্রমণ চালাতো। কোনো বিরতি ছাতা, লাগাতার ছুড়তো।’

শুক্রবার সারাদেশে ১০ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শহিদ হন। অব্যাহত হত্যার প্রতিবাদে মরণপণ যুদ্ধে যোগ দেয় এ অঞ্চলের মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘কোটা নিয়ে আমাদের চাহিদা নেই, এখানে আমাদের প্রত্যাশারও কিছু নেই। আমরা মাঠে নেমেছি এই কারণে যে, আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি মুসলিম এক দেহের মতো। আমরা দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কী ভয়াবহভাবে আমাদের বোনদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আবু সাঈদকে শহিদ করে দিয়েছে। এগুলো দেখার পর একজন মুসলিম ঘরে বসে থাকতে পারে না। আমাদের মনে হয়েছে আমরা এবার আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করবো নাহলে আমরা নিজেরা শহিদ হয়ে যাবো।’

অন্যদিকে আন্দোলন দুর্বল করতে আলেমদের নিয়ে তখন দফায় দফায় বৈঠক করেন তৎকালীন সরকারের মন্ত্রীরা। এমন সময় তরুণ আলেমদের নিয়ে সাধারণ আলেম সমাজ নামে একটা নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইন্টারনেট বন্ধের পর থেকেই দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে তারা।

এদিকে কমপ্লিট শাটডাউনের প্রথম দিন ১৮ জুলাই থেকে প্রতিরোধ গড়ো তোলে উত্তরাবাসী। বিএনএস সেন্টারের কর্মসূচিতে ছাত্র-জনতার পাশে যোগ দেয় এ অঞ্চলের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও।

তবে অপ্রতিরোধ্য জনবল নিয়ে স্বৈরাচারের সহযোগীদের প্রতিরোধ করে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ২০ দিনের আন্দোলনে শহিদ পাঁচ জন। শুধু টঙ্গী ক্যাম্পাস থেকে আহত হয় পাঁচ শতাধিক।

তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার তৎকালীন ভিপি আব্দুল্লাহ আল মিনহাজ বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকরা যেভাবে ফ্যারিবাদের আমলে নির্যাতিত হয়েছে তার থেকে মাদ্রাসার ছাত্ররা বেশি বঞ্চিত ছিল। যার কারণে তারা সবসময়ই এই ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাঁচার জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে এ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৮ তারিখে আমি নিজে সেখানে গুলিবিদ্ধ হই। আমার তামিরুল মিল্লাতের একজন ওইদিন শহিদ হন।’

এক বছর আগের দগদগে স্মৃতি বয়ে চলেছেন তামিরুল মিল্লাতের এইচএসসি পরীক্ষার্থী গাজী জোনায়েদ।

তিনি বলেন, ‘তামিরুল মিল্লাতে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানে প্রতিনিয়ত আমরা আন্দোলনে শরীক হতাম। আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য দায়িত্বশীল ভাইয়ের পরামর্শ থেকে শুরু করে আমরা সবরকম কার্যক্রম চালাতাম। যখন আমি আজমপুর ওভারপাসের নিচে অবস্থানরত ছিলাম ঠিক সেই সময় উত্তরা পূর্ব থানার ছাদ থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি করা হয় আমার দিকে লক্ষ্য করে। একটি বুলেট আমার ডান হাতের একপাশে লেগে অন্যপাশে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয় বুলেটটি আমার বুকের নিচে সে লাগে।’

ঢাকায় মোহাম্মদপুর, মিরপুর, রামপুরা-বাড্ডা ও বারিধারার পাশাপাশি সারাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও গণঅভ্যুত্থানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে ৫ আগস্ট পালিয়ে যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একদিকে যখন বিজয়োল্লাস তখন যাত্রাবাড়ী কাজলার পাড়ের মাদ্রাসা শিক্ষক খোবায়েবকে খুঁজছিলেন বাবা।

শহিদ খোবায়েবের বাবা শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুর রাহমান উজানী বলেন, ‘আমার ছেলে খোবাইব, আমাদের এই মাদ্রাসাতেই তাকে ওস্তাদ হিসেবে রাখা হয়েছে, এখানেই পড়াতো। বিবাহের প্রস্তাব বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে, বিবাহ করাই না, করাবো এই আশা। ৪ আগস্টে তার আম্মাকে বলে, আম্মা আপনারা না আমার নাম খোবাইব রাখছেন, হযরত খোবাইব তো শহিদ হয়েছে। আব্বা আম্মার দোয়া তো কবুল হয়, আপনারা দোয়া করেন আল্লাহ যে আমাকে শহিদ হিসেবে কবুল করে নেয়।’

অভ্যুত্থানের এক বছর পর সাধারণ আলেম সমাজ মনে করে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভুলে যেতে বসেছে রাষ্ট্র।

আলেম সমাজের আহ্বায়ক মুহাম্মদ রিদওয়ান হাসান বলেন, ‘যখনই কোনো আন্দোলনে এই ধর্মীয় জনগোষ্ঠী একদম নৈতিক সমর্থন দিয়ে দেবে সে আন্দোলন সফল। আমরা এটাকে পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব মনে করতে পারছি না। কারণ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে আমরা যখন দেখলাম যে বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, বাংলা বসন্ত বাংলার মানুষ দেখেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে, সেটাকে নানাভাবে ফিল্টারিং রক্ষা হচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে, এইভাবে না এইভাবে। একটা রাষ্ট্রীয় ফরম্যাট দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু দেখবেন যে, রাষ্ট্রীয় ফরম্যাটে কিন্তু চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান হয়নি।’

মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাশাপাশি নৈতিক পরিবর্তন জরুরি।

এসএস