জীবিত থেকেও সরকারি কাগজে মৃত; বয়স্ক ভাতা হারালেন ৯৩ বছরের তারামন বিবি

মানিকগঞ্জ
তারামন বিবি
এখন জনপদে
0

৯৩ বছর বয়সী তারামন বিবি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যুদ্ধ করছেন এক গভীর অবহেলার বিরুদ্ধে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই নারী এখনো আশ্রয় নিয়েছেন বিনোদগালা গ্রামের এক কোণে। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে ন্যায্য অধিকারটুকুও যেন কেড়ে নিয়েছে প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতা। সরকারি খাতায় তাকে ‘মৃত’ ঘোষণা করা হয়েছে! আর সেই অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রায় দুই দশক ধরে পাওয়া বয়স্ক ভাতা। তারামনের নামে থাকা কার্ডটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে অন্য এক ব্যক্তিকে। যেন কাগজে মৃত্যুই এখন বাস্তব, আর বাস্তব জীবন হয়ে উঠেছে অদৃশ্য।

এ ঘটনা ঘটেছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

তারামন বিবি বলেন, ‘আমি বেঁচে আছি, কিন্তু কাগজে আমারে মরা বানাইছে। ভাতার টাকাও পাই না। ১৬-১৭ বছর ধইরা ভাতা পাইতাম, হঠাৎ কাইটা দিছে।’

তার ছেলে হাসমত মোল্লা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে গত ১৪ জুলাই হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযোগে তিনি স্থানীয় ইউপি সদস্য দেওয়ান হাবিবুর রহমান হারেজের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘গত এক বছর ধরে আমার মাকে মৃত দেখিয়ে তার ভাতা অন্য একজনকে দেয়া হয়েছে। অথচ তিনি এখনো বেঁচে আছেন। তিনি প্রভাব খাটিয়ে আমার মাকে মৃত দেখিয়ে অন্যকে ভাতা কার্ড দিয়েছেন।’

অভিযোগের তীর গালা ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও স্থানীয় বিএনপি নেতা দেওয়ান হাবিবুর রহমান হারেজের দিকে। তিনি নিজেই গালা ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, ‘আমার একটু ভুল হয়েছে। আমি মৃত সনদ দেয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুলে মৃতের প্রত্যয়ন দেয়া হয়েছে।’

তিনি আরও দাবি করেন, যার নাম কার্ডে উঠেছে, তার কাছ থেকে আমি কোনো বাড়তি সুবিধা নিইনি।

হরিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আঈয়ুব আলী বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের প্রত্যয়নের ভিত্তিতেই তারামন বিবিকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।’

এ ঘটনায় ইউএনও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা বললেও ১৬ দিনেও কেন তা দেয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটু দেরি হয়ে গেছে।’ আর তারামন বিবির কার্ডের বিষয়ে দেখবেন বলেও জানান তিনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেমন- বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বড় একটি ভরসা। কিন্তু এ সুবিধা যদি কোনো প্রতিহিংসা, অবহেলা কিংবা দুর্নীতির শিকার হয়, তাহলে তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। তারামন বিবি বেঁচে থাকার পরও কীভাবে তাকে মৃত দেখিয়ে তার বয়স্ক ভাতা কার্ড বন্ধ করা হলো, সে বিষয়ে তদন্ত করে দোষীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক।’

এ বিষয়ে হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর আক্তার বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। সমাজসেবা কর্মকর্তাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। যদি অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকেই বলছেন, একজন জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে তার প্রাপ্য সুবিধা কেড়ে নেয়া চরম অমানবিক কাজ। তারা দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি তারামন বিবির ভাতার কার্ড ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

সেজু